১৭ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৫:৫৪

অন্যরকম এক বিকেলের গল্প (পথকলি ও আমি)

শেলী সেলিনা আলম

অন্যরকম এক বিকেলের গল্প (পথকলি ও আমি)

অফিস থেকে বের হয়েছি বেলা ২.৩০ মিনিটে। গন্তব্য কড়াইল বস্তি ।ওখানে বাংলার পাঠশালা পরিচালিত একটা স্কুল আছে।

৪.৩০ মিনিটে গুলশান ১ অতিক্রম করে মহাখালি যাবার পথে ডানদিকে একটা ঘাটের কাছে এসে গাড়ি থামাতে হলো। বাংলার পাঠশালার কর্ণধার দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

কাছাকাছি পৌঁছতেই উনি জানালেন, এখান থেকে নৌকায় করে গুলশান লেকের ওপর দিয়ে ওপারে কড়াইল বস্তিতে পৌঁছাতে হবে।

লোকটা বলে কি? ঢাকায় বসে নৌকা পারাপার!! তাও আবার গুলশান এলাকায়?

চারপাশে লোকজন ছুটছে। বাস, প্রাইভেট কার, রিক্সাও চলছে। আর এর মাঝেই কি না নদী পারাপারের মতো অবস্থা?

একটার পর একটা নৌকা ঘাটে আসছে, লোকজন উঠে পড়ছে। এতো সাবলীল গতি, বোঝাই যাচ্ছে, এটা ওদের দৈনন্দিন বিষয়।

একটা রিজার্ভ করা নৌকায় আমরা ৩ জন উঠলাম। আমি আর বাংলার পাঠশালার ২ জন। অস্তগামী সূর্যটা লালচে আভা ছড়িয়ে লেকের জলে খেলা করছিলো। ঘোলা জল, আকাশের ছায়া ঠিক মতো দেখাও যায় না। তার ওপর পানির তীব্র পচা গন্ধ। অসহনীয় সে অবস্থা। ইস!!! এতো কস্ট করে মানুষগুলো প্রতিদিন এভাবে আসা যাওয়া করে? চমৎকার একটা লেক অথচ কি করুণ দশা?
ভাবতে ভাবতে করাইল বস্তিতে চলে এসেছি।

নৌকা থেকে নেমেই সামনে কিছু দোকান। ঔষধের দোকানে একজন মহিলা বিক্রেতা। ভালো লাগলো দৃশ্যটা দেখে। একটা সমবায় সমিতিরও দেখা মিললো। এরা দেখি আবার টাকাও লোন দেয়। দেখতে দেখতে সামনে এগুচ্ছি। অসম্ভব ঘন বসতি। খোঁজ নিলাম। জনসংখ্যার পরিমাণ এখানে প্রায় ২ লক্ষ। টিনের দোতালা বাড়ি, এক চালা ঘর, সেমি পাকা বিল্ডিং - নানা রকম ডিজাইনের ছোটো ছোটো আরো অনেক ঘর - একটার সাথে আরেকটা লাগানো। রাস্তাগুলো খুবই সরু - পাশাপাশি দুজন চলাও যায় না, এমন অবস্থা। অলি গলি পার হয়ে একটা পুরনো, প্রায় নড়বড়ে একটা টিনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

ঘরে ঠিকমতো ঢুকতে না ঢুকতেই সমস্বরে অনেকগুলো বাচ্চা ছেলে মেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো -

" আসসালামু অলাইকুম স্যার"।

পাশে তাকালাম, কেউ নেই - ওরা আমাকেই বলছে।

আমিও অনেকটা গলা উঁচু করেই বললাম, " অলাইকুম আসসালাম"।

" স্যার আপনি কেমন আছেন, আসতে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?" - বাচ্চাগুলো গলার সাথা গলা মিলিয়ে একসাথে আবারও আমায় জিজ্ঞেস করলো।

বললাম, " না কোনো অসুবিধা হয়নি। তোমরা ভালো আছো?।

আবারও কণ্ঠ উঁচিয়ে ওরা বললো, " জ্বী স্যার "।

বুঝলাম, এদের যথেষ্ট ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, তা না হলে এতোটা সহজ ওরা হতে পারতো না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছাত্র ক্লাশ নিচ্ছিলো। সে সবার কাছে আমার পরিচয় তুলে ধরলো।

অনেক গল্প হলো ওদের সাথে। ওদের পছন্দ অপছন্দ, ভালো লাগা, কবিতা আবৃত্তি, গান শোনা, নাচ করা - সবকুছুতেই আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কতো হবে ওদের বয়স? বড়জোর, ৫ থেকে ৭/৮ বছর। আমাদের বাচ্চাগুলো এই বয়সেও অনেক নাজুক, কিছু একটা বললে উশখুশ করতে থাকে। আর এরা? বললাম, " নাচ দেখবো"। অমনি দুজন দাঁড়িয়ে মোবাইলের গানের তালে তালে নাচতে শুরু করলো।

গান গাইতে বললাম। দুজন পর পর ২টা দেশের গান শুনিয়ে দিলো।নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা - কে কার আগে তার পারফরমেন্স দেখাবে। খুব ভালো লাগছিলো ওদের সঙ্গ। জীবন নিয়ে ওদের বড় রকম কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই।পড়াশোনা করতে হবে, বাইরে কাজ করে উপার্জন করতে হবে, বাড়িতে মাকে কাজে সাহায্য করতে হবে, ছোটো ভাই বোনের খেয়াল করতে হবে - এটাই এখন মুখ্য।

অনেক কথা বলতে বলতে এক সময় বললাম, " তোমরা কি টাকা জমাও"।

কেউ কেউ উত্তর দিলো, তারা মাটির ব্যাংকে টাকা জমায়। বললাম, " তোমরা যদি ব্যাংকে টাকা জমাতে পারো কেমন হয়?"

সবাই চিৎকার করে উঠলো, " অনেক ভালো হয় স্যার।"

ওদেরকে বুঝিয়ে আসলাম, কে তোমাদের এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গভর্ণরের নাম ওদের মুখস্ত করিয়ে এলাম। খুব মজা লাগলো, ওরা নামতা পড়ার মতো " ড. আতিউর রহমান" - এর নাম মুখস্ত করতে লাগলো।

আসার সময় ওদের জন্য কিছুই নিয়ে আসিনি। এতোগুলো কচি মুখ, মায়া কাড়া চেহারা।কেমন এক ধরনের খারাপ লাগছে। একজনকে বললাম, " সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসো"।

মিষ্টি আসার পর ওদের মাঝে চাঞ্চল্য বেড়ে গেলো। সে দৃশ্য দেখার মতো। ওরা খুব মজা করে মিষ্টি খাচ্ছে - আমাকেও সাধছে। আমিও হাত বাড়িয়ে মিষ্টি নিলাম।

খাওয়া দাওয়ার পর বিদায়ের পালা। ওরা বারবার বলতে লাগলো, " আপনি আবার কবে আসবেন স্যার"?

বললাম, " খুব শীঘ্রই আসবো।

আমাকে তো আসতেই হবে। বারবার আসতে চাই।

এতোক্ষন যাদের কথা বলেছি, তারা পথকলি। টোকাই নামে যারা পরিচিত ছিলো। কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী বা রণবীর আঁকা টোকাই এর প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। টোকাই সমাজের অনেক অসঙ্গতিকে ইংগিত করে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। ফান এর মাধ্যমে বিদ্রূপ করে নীরব প্রতিবাদ করেছে।

পথে পথে ঘুরে বেড়ানো পথশিশু - যাদের বাসস্থান বাস স্টপেজ, রেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, বিপণী কেন্দ্রের আশপাশ, ডাস্টবিন, কংক্রিটের পাইপ, ফুটপাত, রাজপথের মাঝখানের আইল্যান্ডে, , কিংবা ব্যস্ততম বাজার এর আশেপাশের ছোট্ট চিপাচাপা বা অলিগলিতে। এদের কারো বাবা নেই, কারো মা নেই, কারো বা বাবা -মা থেকেও নেই। কেউ কেউ জানেও না তাদের বাবা - মা আদৌ ছিলো কি না। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। এই পথশিশুদের প্রতিনিধিত্ব করেছে "টোকাই" চরিত্র।

আমাদের এক সময়কার প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ সম্ভবত এই পথশিশুদের টোকাই খোলস ভেঙে "পথকলি" বলে পরিচিতি দিতে চেয়েছিলেন। পথকলিদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে, অনেক NGO তাদের নিয়ে কাজ করছে। এই মূহুর্তে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাননীয় গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ব্যাংকে হিসাব খোলার মাধ্যমে তাদেরকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পথকলিদের ব্যাংক হিসাব খোলা সেই প্রচেষ্টারই একটা ক্ষুদ্র অংশ। সে কথা না হয় আরেকদিন বলবো।

আমি শুধু ভাবি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাসমান এই পথকলি শ্রেণীটা আরো কতো কতো সময় পার হলে শুধু মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে? এ দেশ আরো কতোটা এগুলে এই পথশিশুরা কখনো টোকাই, কখনোবা পথকলি বলে পরিচিত হবে না? আমাদের আর সব শিশুর মতো ওরাও শুধু শিশু বলেই গণ্য হবে?

কলি শব্দটা ফুল ফোঁটার পূর্ব মুহূর্ত বোঝালেও পথকলি শব্দটা কি পথে পথে বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়ানো শিশুগুলোর বিকাশের পূর্ব মুহূর্ত বোঝায়? আর সব শিশুদের মতো একদিন তাদের কৈশোর পার হয়ে তারুণ্য দ্বীপ্ত হবে?

যৌবনে উপবিষ্ট হয়ে ভীষন রকম দাবড়ে বেড়াবে সমাজের নানা অন্যায় আর অসঙ্গতির বিরুদ্ধে?

স্বপ্ন দেখবে আগামী দিনের, নতুন জীবনের জাল বুনবে প্রত্যাশায়, নূতন সম্ভাবনায় ?

এর উত্তর আমার জানা নেই।

(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত) 


বিডি-প্রতিদিন/ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর