৫ আগস্ট, ২০২০ ১৬:০৩

ফেসবুক ব্যবহারে সিপিবি'র বিধি-নিষেধ তরুণ প্রজন্মকে ভুলবার্তা দেবে!

মঞ্জুরে খোদা টরিক

ফেসবুক ব্যবহারে সিপিবি'র বিধি-নিষেধ তরুণ প্রজন্মকে ভুলবার্তা দেবে!

মঞ্জুরে খোদা টরিক

১। সিপিবি’র গত সম্মেলনের আগে পার্টির এক নেতার সাথে সংগঠন নিয়ে আলাপ হয়েছিল। তখন আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, সিপিবি’র নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে, তরুণদের দায়িত্ব দিতে হবে। ষাটোর্ধ্ব নেতাদের আপাতত সরিয়ে রাখতে হবে। তিনি বললেন, না না তা হবে না, সিপিবিতে এখনও সেলিম ভাইয়ের বিকল্প নেই (আমার কাছে সেলিম ভায়ের বিষয়টি প্রতিকী ছিল)। তাকে বাদ দিয়ে এখন নেতৃত্ব নির্বাচনের চিন্তা করা যাবে না! তখন আমার মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগও মনে করে তাদের দলে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই! বিএনপিও মনে করে খালেদা জিয়ার বিকল্প নেই। তাদের দলের নেতাকর্মীরাও মনে করে তাদের ছাড়া দল চলবে না। দলের কাউন্সিলেও উনারা নেতাকর্মীদের শতভাগ সমর্থনে-ভোটেই নির্বাচিত হন। তাই মনে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের নীতিবোধগুলো এমন স্ববিরোধী!

২। এন্ড্রু শিয়ার, সুশিক্ষিত ও সুদর্শন যুবক, বয়স ৪১, কানাডার প্রধান বিরোধী রক্ষণশীল দলের প্রধান নেতা। এ মাসেই দল থেকে তাকে সরিয়ে নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের একটি প্রধান কারণ গত নির্বাচনে তার নেতৃত্বে দলটি ক্ষমতায় যেতে পারেনি, এবং নেতা হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি সে কারণে তাকে চলে যেতে হবে। যদিও ক্ষমতাসীনদের তুলনায় তার দলই বেশী ভোট পেয়েছিল। আমাদের দেশের বামদলগুলো যুগের পর যুগ ক্ষমতায় যাওয়া তো দূরের কথা, সংসদে কেন একটি আসনেও জিততে পারছে না, কোন নেতৃত্বই সে ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা দেখেন না! এখানেই পার্থক্য ও বৈপরীত্য উন্নত দেশের সাথে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির। আমরা কেবল ব্যর্থতা খুঁজে পাই সরকার ও প্রশাসনে, অন্য কোথাও নয়!

৩। সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার বিষয়ক একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছেন (ছবি সংযুক্ত)। এটি অবশ্যই সংগঠনের আভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক বিষয়। সে বিবেচনায় তা দলের বিভিন্ন ইউনিটে সার্কুলার মাধ্যমে প্রচার করাই সমীচীন ছিল। হয়তো বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেই প্রচার করা হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দল যদি তাদের দলীয় শৃঙ্খলার কারণে নেতাকর্মীদের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন একটি নীতিমালা-নির্দেশনা প্রদান করতে পারে, একই কারণে শাসক দল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরির যৌক্তিকতার কথা বললে কি অন্যায় হবে? এ বছর সরকারও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য এমন একটি নীতিমালা ঘোষণা করেছে। আমরা সবাই তার তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। এখন আমরা কি সে সমালোচনা প্রত্যাহার করে নেবো? সরকারি এই নীতিমালার সাথে সিপিবির এই নীতিমালার বিরোধ-পার্থক্য কোথায়?

৪। সিপিবি কখনো ক্ষমতায় যায়নি, সে সম্ভাবনা কতটুকু সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু তার আগেই নেতাকর্মীদের স্বাধীন মত প্রকাশ-প্রচারের উপর শাসকদের মত এমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এটা কি মতপ্রকাশ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরোধী নয়? কণ্ঠরোধ নয়? সামাজিক মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক, ক্রিটিক্যাল চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করলে তরুণ প্রজন্মকে ভুলবার্তা দেবে। তারা এ সংগঠনে আগ্রহী হবে না। ব্যক্তি জীবন নিয়ে এক সময় বাম রাজনীতির নানা আলোচনা ছিল তা আবার নতুন করে শুরু হবে, তরুণদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করবে, সংগঠন সম্পর্কে বৈরি মনোভাব হবে। যে কারণে সিপিবি’র এমন অবস্থানকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছি না।

৫। গত সিটি নির্বাচনে বরিশালে ডা. মনীষার সমর্থনে একটি নোট প্রকাশের কারণে, সিপিবি নেতাকর্মীদের অনেক তীর্যক-বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য শুনতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে সংসদ নির্বাচনে নেই, কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আছি এমন অবস্থানের সমালোচনা করাতেও নেতিবাচক মন্তব্যের স্বীকার হয়েছি। এমন আরও অনেক বিষয়ে আমার অবস্থান ছিল ভিন্ন। আমি সিপিবি’র সভ্য না হলেও নিজেকে এই দলের একজন শুভাকাঙ্খী মনে করি। সদস্য হলে নিজেকে স্বাধীন মতামতের জায়গায় রাখতে পারতাম না। বলতে পারেন দলীয় ফোরামে সে আলোচনা করা যাবে। আমি সবকিছুর আমলাতান্ত্রিকতা ও কেন্দ্রীকতা সমর্থন করতে পারি না। বিষয়টি যদি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই হবে, তাহলে ফেসবুক সংক্রান্ত সিপিবির এই সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে না রেখে কেন ফলাও করে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে?

৬। আপনার দলের সদস্যদের আলোচনা ফেসবুকে নিয়ন্ত্রণ করলেন, কিন্তু সংগঠনের বাইরের মানুষের আলাপ থামাবেন কিভাবে? বাইরের সে সব মানুষের প্রত্যেকটা সমালোচনার জবাব দিতে কি মিটিং করে করে, তার ড্রাফট করে, তার দাড়ি-কমা পর্যালোচনা করে তারপরে জবাব দেবেন? ফেসবুকের যে পরিধি, ক্ষিপ্রতা ও গতিময়তা প্রতিদিন এমন কয়টি আলোচনা-সমালোচনার জবাব দেবেন? বুঝতে পারছেন কি এরজন্য কতগুলো সভা, কত শ্রমঘণ্টা ব্যয় করতে হবে? 

সভ্যদের জন্য বিষয়টিকে এতোটা মেকানিক্যাল করা কি বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সাজে? তারমানে কোন সদস্যকে সংগঠন সংশ্লিষ্ট কিছু লিখতে হলে, আগে কি লিখবে, সেটা লিখে পার্টিতে অনুমোদন করিয়ে, তারপরে প্রকাশ করতে হবে? আপনারা কিভাবে এ পদ্ধতিকে সঠিক মনে করেন, ঠিক বুঝতে পারছি না! সংগঠনে শৃঙ্খলা, সমন্বয়, হারমনি আনতে অনেক পথ-পদ্ধতি আছে সেদিকে না গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত সমাজে ভুলবার্তা ছড়াবে।

৭। আমি মনে করি, মতপ্রকাশে এমন নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে বরং সংগঠনের নেতাকর্মীদের জন্য ফেসবুক ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ভাষা, বিষয়, রুচি, সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ-কর্মশালার ব্যবস্থা করা গেলে সংগঠন উপকৃত হবে। সেই জ্ঞান-বোধ-বিবেচনাই নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উন্নত অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, এরাই ভার্চ্যুয়াল জগতে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর