২৭ জানুয়ারি, ২০২২ ১৫:০০

আমার দেখা ওয়ান ইলেভেন (পর্ব-৫)

অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু

আমার দেখা ওয়ান ইলেভেন (পর্ব-৫)

আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও ডা. জাহানারা আরজু

সংসদ এলাকা হতে বাসায় এসে আম্মাকে বললাম, তাদেরকে অনেকবার বলেছি দেখুন, নাসিম তো সরকারি চাকুরিতে আছে। সে তার দায়িত্ব পালন করেছে শুধু। 

তখনি নাসিম কানাডা হতে ফোন করল। বললাম, এত রাতেও ঘুমাওনি? সে জানতে চাইল, কি জিজ্ঞেস করল আমাকে? বললাম। সব শুনে সে বলল, বিনা কারণে কত জনকে হয়রানি করছে তারা। স্ত্রী, সন্তান, মেয়ে জামাই সবাইকে জেলে ঢোকাচ্ছে। 

কিন্তু তখনও আমি বুঝতে পারিনি যে আমার দেশে আসাটা তারা ভাল চোখে দেখেনি। শুধু MD degree পাওয়ার জন্যে জীবনের পরোয়া করিনি। এটা তারা মানতে পারছিলেন না। 

২/১ মাস পরে চট্টগ্রামে আমাদের বাসাতেও গিয়েছিলেন তারা। পাহাড়ের উপর ২ বিঘার উপর বাড়িটির সামনের ও পেছনের জায়গাগুলো গজ ফিতা দিয়ে মাপজোখ করছিল। তখন আমার মরহুম পিতা বলেছিলেন, “তোমরা যার জন্যে তদন্ত করতে এখানে এসেছ, তার জন্মের আগেই আমরা এই বাড়ি কিনেছি।’’ 

এভাবে দিন যায়; সকাল ৮ টা থেকে হাসপাতালের ডিউটি, পড়াশোনা আর মাঝে মাঝে দুদকের চিঠি। ভয়ে বাসায় যেতাম না। রাত ৮টা/৯টা পর্যন্ত হাসপাতালে রোগীর বিছানার পাশে পড়াশোনা করতাম। প্রয়াত ছোট ভাই Bikash Siddhartha (আল্লাহ এই নিস্পাপ ছেলেটাকে ওপারে ভাল রাখুন) আর  Anisul Awal ভাই ছিলেন পড়ার সঙ্গী। তারা দুজনই ওই দুঃসময়ে লেখাপড়ার সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন। 

একদিন বিকেল ৪টার দিকে নাসিম ফোন করে বলল, তোমাদের কার্ডিওলজি বিভাগের ৪তলাতে ওয়ার্ডের মাঝের রুমে কার কার সাথে পড়ছ তুমি এখন? শুনেই ডানে-বামে তাকালাম। কে দেখছে আমাদের? তখন নাসিম বলল, SB এর একজন অফিসার নাসিমকে ফোনে আমার অবস্থান জানিয়েছে। ফোন রাখার পর সাদা পোশাকের এক ভদ্রলোক পরিচয় দিয়ে বললেন, নাসিম ভাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। তাঁকে আমি দেখেছিলাম ওয়ার্ডে বন্দী অবস্থায় ভর্তি TNT এর ডিরেক্টর তৌফিক ভাইয়ের পাশে বসে কথা বলতে। ভাইকে পরে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে interrogation এ থাকি আমি। DB আর SB এর লোকজন আসে। 

সেদিনই প্রথম জানলাম আমাদের হাসপাতালে বিভিন্ন এজেন্সির লোকজন ঘোরাঘুরি করেন। 

একদিন দুদক মরহুম শ্বশুর ও আর বাবাকেও ডেকেছিল তাদের অফিসে। বেচারা দুজন যখন গেলেন, ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাদের। বিশেষ করে দুজনই কানে কম শুনতেন, কিন্তু কেউই স্বীকার করতেন না। 

এর মাঝে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী ফোন করল নাসিমকে। তার এক কলিগের (নাসিমের বন্ধু) কাছে কানাডার নাম্বার ছিল। নাসিম তাঁর পরিচয় জেনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে জবাব দিচ্ছিল। তখন বারী সাহেব নরম সুরে বললেন, দেখুন আপনার বিরুদ্ধে তদন্ত করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আপনি একটা পোস্টিং এ ছিলেন, তাই এমন হয়েছে। নাসিম বলল, আপনিও তো একটা পোস্টিং এ আছেন। সময় হলে আপনার অবস্থা কি হবে ভেবে দেখুন। 

তারপরই শেখ রেহানা আপাকে (ছোট আপা) লন্ডনে ফোন করেছিল নাসিম। আপা বললেন, আরজুকে কোথাও যেতে মানা কর। ওদের দিন শেষ। 

পরে ঠিকই মিথ্যে মামলা দিল আমাদের নামে। আমার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটের ডেভেলপারের অফিসে একদিন হানা দিল তারা। আমাদের টাকা পরিশোধের রিসিটগুলো জোগাড় করল। ডেভেলপারও ছিলেন বান্ধবী Ishita Nasreen Haq ইশিতার মরহুম বাবা আজহার আঙ্কেল। তিনি ছিলেন, ঢাকা ওয়াসার এমডি। জায়গাটা আঙ্কেলদের পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল। তাই আমাদের কাছে ফ্ল্যাটটি কম দামে বিক্রি করেন। যাই হোক এই এপার্টমেন্ট নিয়ে তারা মিথ্যা একটা মামলা তৈরি করল। 

আমি আঙ্কেলকে বলার পর তিনি আমাকে একই রকম সব ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশনের কপি দিয়ে দিলেন। বললেন, দরকার হলে আরও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে পারব। তুমি কোন চিন্তা কর না মা। “তুমি আর ইশিতা দেশে কেন পড়ে আছ? No doubt there must be some similarities between you two. That’s why you are friends.’’

দুদকের তখনকার চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধূরী ছিলেন কানাডার সারোয়ার ভাইয়ের আত্মীয়। ভাবিকে দেখা করার অনুরোধ করি, কিন্তু হাসান সাহেব রাজি হলেন না। তাঁর সাথে ফোনে শুধু এটুকু বললাম, “আমি শুধু পড়া শেষ করতে চাই। MD Course টা শেষ হলেই চলে যাব।”

পরে শুনলাম তিনি সম্মত হয়েছিলেন যে আমাকে আর বিরক্ত করা হবে না। কিন্তু তৎকালিন ক্ষমতাধর একজন জেনারেল নাকি বলেছিলেন, আলাউদ্দিন সাহেব আর তার স্ত্রী; কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। 

চলবে…

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর