পাড়ার মাংসের দোকানে যে মুরগিগুলো কাটা হচ্ছে, সেগুলো আসলে কী জানেন? বা যে কাকটা আপনার বারান্দার রেলিংয়ে বসে রোজ কা-কা আওয়াজ তোলে, সেটা? আর চিড়িয়াখানা গিয়ে আপনি যে ময়ূরের পেখম তোলার ছবি তোলার জন্য হাঁকপাঁক করেন৷ সেটিই বা কী?
সব সওয়ালের একই জবাব৷ ডাইনোসর!
'জুরাসিক পাক' বা 'লস্ট ওয়ার্ল্ডে'র টির্যানোসরাস রেক্সদের হাঁটাটা একবার স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বার করুন৷ কিছুটা যেন পাখির হাঁটার সঙ্গে মিল আছে না? শুধু কি হাঁটায়? তাদের শরীরের গঠনে, বিশেষ করে উরুতে পাখিদের সঙ্গে মিল ছিল যথেষ্ট৷ পালকও ছিল অল্প অল্প৷ ফুসফুসের সঙ্গে মিল ছিল পাখিদের ফুসফুসের৷ এখান থেকেই চিরকালীন বিতর্কিত প্রশ্নটির উত্পত্তি, ডাইনোসরদের কি আদৌ সরীসৃপ বলা যায়? তারা কি শীতল রক্তের প্রাণী ছিল? নাকি, পাখির এই পূর্বপুরুষরা ছিল উষ্ণ রক্তের, সরীসৃপদের সঙ্গে মিল থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের প্রাণী?
এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন কিছু জীবাশ্মবিদ৷ তাঁদের রীতিমতো দীর্ঘ দিনের গবেষণার এই ফল বেরিয়েছে 'সায়েন্স' জার্নালে৷ এই অগস্ট মাসেই৷ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল লি এবং তাঁর সহকর্মীরা ওই গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, ডাইনোসর থেকে পাখিতে রূপান্তরিত হওয়ার বিবর্তনের পথ৷
বিশালকায় লম্বা লম্বা ডাইনোসরগুলোর বিবর্তনের পদ্ধতিতে ছিল 'মিনিয়েচারাইজেশন'৷ অর্থাত্, ক্ষুদ্রকরণ৷ ৫ কোটি বছর ধরে ক্রমশ ছোট হয়েছে থেরোপড (সব মাংসাশী ডাইনোসর এই গোত্রেই পড়ে) গোত্রীয় ডাইনোসর৷ ১২টা শাখায় বিভক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধাপে৷ তার পর এসেছে আজকের পাখিরা৷ এই ৫ কোটি বছরে যে গতিতে পাখিদের কঙ্কালের অভিযোজন হয়েছে, সেটা সাধারণ ডাইনোসরদের অভিযোজনের তুলনায় চারগুণ দ্রুততর৷ অদ্ভুত ভাবে দেখা যাচ্ছে, এ বদলগুলো অধিকাংশ এসেছে মাংসাশী ডাইনোসরদের ক্ষেত্রেই৷
বিজ্ঞানীরা এর জন্য প্রথমে জোগাড় করেছেন বিভিন্ন ডাইনোসরদের শরীরের আকারের বিশাল পরিসংখ্যান৷ খুঁজে বার করেছেন ডাইনোসরদের নতুন ফ্যামিলি ট্রি৷ আর সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর ঘাঁটাঘঁটি করতে হয়েছে বিবর্তনের গতিপথ বোঝাতে৷ যে পদ্ধতিটি বিজ্ঞানীরা প্রয়োগ করেছেন, সেটার পোশাকি নাম-'বায়েসিয়ান অ্যাপ্রোচ'৷ এই পদ্ধতিটি সাধারণত ব্যবহার করা হত ইভোলিউশনারি ভাইরোলজির ক্ষেত্রে৷ যেখানে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া এবং তার আণবিক বিবর্তনের (মলিকিউলার ইভোলিউশন) হার নির্ণয় করা হত৷
কী ভাবে ছোট হল ডাইনোসরদের আকার? ৫ কোটি বছর ধরে হওয়া এই বিবর্তনে পৃথিবীতে এসেছে ১২টি ভিন্ন প্রজাতি৷ তারাও ক্রমে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে৷ রয়ে গিয়েছে শেষ বংশধরেরা৷ অর্থাত্ পাখির প্রায় ১০ হাজার প্রজাতি৷ থেরোপডদের মধ্যে টেটানুরির পর থেকে শুরু হয়েছিল 'মিনিয়েচারাইজেশন'৷ প্রায় ১৯ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত টেটানুরান প্রজাতির ডাইনোসররা৷ যাদের গড় ওজন ছিল প্রায় ১৬৩ কিলোগ্রাম৷ ভীষণ দ্রুত ক্ষুদ্রকরণ হয়ে পরের প্রজাতির আবির্ভাব প্রায় ১৭ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে৷ সেই নিওটেটানুরান বা অ্যাভেথেরোপডদের গড় ওজন ছিল ৪৬ কিলোগ্রাম৷
নিওটেটানুরানদের পর ক্রমশ ছোট হতে হতে আসে সিলুরোসর৷ ১৭ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগে৷ এদের গড় ওজন ছিল ২৭ কিলোগ্রাম৷ তার প্রায় ৩০ লক্ষ বছর পর আসে ম্যানির্যাপ্টর (গড় ওজন ১০ কিলোগ্রাম)৷ তার প্রায় ৩০ লক্ষ বছর পর আসে প্যারাভিয়ান্স৷ যাদের গড় ওজন ৩ কিলোগ্রাম৷ শেষে পাখিদের আবির্ভাব ১৬ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগে৷ যাদের গড় ওজন প্রায় ৮০০ গ্রাম৷ এই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য মাইকেল লি-রা প্রায় দু'হাজার ডেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন৷ যার মধ্যে ছিল পাখিদের শরীরের নানা বৈশিষ্ট্য৷ ফিমারের দৈর্ঘ থেকে অন্যান্য অ্যানাটমিক্যাল বৈশিষ্ট্য৷ বিজ্ঞানীদের দাবি, ৫ কোটি বছর ধরে বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে ক্রমশ যোগ হয়েছে পাখির বৈশিষ্ট্যগুলো৷ যেমন আরও পালক যোগ হওয়া, পাখির হাড়ের নানা পরিবর্তন, পিডোমরফিজম (যেখানে পরিণত বয়সের শরীরেও শিশুর কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে যায়)৷
এতগুলো ধাপ পেরিয়ে তবেই না দানবীয় প্রাণীগুলো বদলে গিয়েছে পাখিতে৷