পাহাড়ের ছনের মাচাং ঘরগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। একসময় পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করে বসবাস করতো। মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যেত এসব পাহাড়ি ছনের ঘর। জানান দিত পাহাড়ি মানুষগুলোর সংস্কৃতির কথা। ছনের ছোট-বড় মাচাং ঘরগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিল।
জানা গেছে, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বন্য পশু ও জীব জন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করতো। মাচাং ঘরগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু করে তৈরি করা হতো। আর মাচাং ঘর তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন আর বাঁশ। তাই একসময় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক ছনের কদর ছিল। কিন্তু বর্তমানে কালের পরিবর্তনে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এসব পাহাড়ি ছন। প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কিছু কিছু এলাকায় ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘর দেখা গেলেও। শহর এলাকায় এখন ছনের ঘর একেবারেই চোখে পড়ে না।
এক সময়ের ছন চাষী জ্যোতিময় চাকমা জানায়, ছন চাষে কমশ্রমে বেশিলাভ থাকলেও এখন আর ছন চাষে আগ্রহী না চাষীরা। কারণ পাহাড়ে ছনের চাহিদা কমে গেছে। কারণ পাহাড়ের মানুষ এখন আর বাঁশ ও ছন দিয়ে ঘর তৈরি করতে চায় না। বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো বেশি দিন টেকসই হয় না। প্রতিবছর বছর মেরামত করতে হয়। যার কারণে প্রত্যন্ত ও দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ছনের চেয়ে বেশি চাহিদা বেড়েছে টিনের। তাই ছনের ঘর দখল করে নিয়েছে টিনের ঘর। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে দেখা মিলে ছোট বড় অসংখ্য টিনের ঘর।
জানা গেছে, আশ্বিন ও চৈত্রমাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়। ছন চাষের জন্য পাহাড়ের ছোট ছোট গাছপালা ও লতাপাতা পরিষ্কার করে দিলেই কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবে ছন জন্মায়। উৎপাদিত ছন গাছগুলো দুই হাত লম্বা হলে আগাছা পরিষ্কার করে একবার ইউরিয়া সার দিতে হয়। এতে ছন গাছ তাড়াতাড়ি বাড়তে পারে। ছন গাছগুলো ৬/৭ ফুট লম্বা হওয়ার পর কাটার উপযুক্ত হয়।
বাজারজাত করার জন্য আহরিত ছনগুলো অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালো করে রোদে শুকানোর পর তা ব্যবহারের উপযোগী হবে। তবে আশ্বিন মাসের ছন বাজারে চাহিদা থাকে না। ফলে বোঝাপ্রতি মাত্র ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয় চাষীদের। তবে বর্ষা মৌসুম ছনের চাহিদা বেশি থাকে। তখন বোঝাপ্রতি ছন ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
এ ব্যাপারে কাউখালী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বিশ্বাস জানান, টিনের চাইতে ছনের ঘর অনেক বেশি শীতল ও ঠাণ্ডা। হাজার বছর ধরে পাহাড়ি মানুষগুলো ছন দিয়ে ঘর তৈরি করতেন। কালের পরিবর্তনে কারণে ছনের ব্যবহার না থাকায় এখন তা অস্তিত্ব হারাচ্ছে। তবে ছন দিয়ে নানাবিধ ব্যবহার বাড়ানো গেলে হয়তো পাহাড়ি ছন রক্ষা করা সম্ভব হবে।