শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

লন্ডনেও রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করলেন মিজারুল কায়েস

লন্ডনেও রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করলেন মিজারুল কায়েস

আগের মতোই লন্ডনেও রাষ্ট্রের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার পেশাদার কূটনীতিক মিজারুল কায়েসের বিরুদ্ধে। তিনি মালদ্বীপে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ছেড়ে রাশিয়ায় নতুন দায়িত্ব পালনে যাওয়ার সময় কেবল মালামাল পরিবহনের খরচ হিসেবে অগ্রিম নেওয়া প্রায় ৫৪ লাখ টাকার হিসাব না দেওয়ায় তখনই কথা ওঠে। একইভাবে রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালে নেওয়া অগ্রিম টাকারও হিসাব দেননি সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব। এবার লন্ডনে দায়িত্ব পালনকালে নতুন করে একই অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, রাশিয়ায় তিন বছর কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালনকালে প্রায় ৮ কোটি টাকার চিত্রকর্ম কিনে বিতর্ক তৈরি করেন মিজারুল কায়েস। এ সময় তিনি নিজের পছন্দের এজেন্ট ও শিল্পীদের কাছ থেকে যেসব শিল্পকর্ম কেনেন তার বেশির ভাগই এখন সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র দফতরের স্টোররুমে ধূলিধূসর অবস্থায় পড়ে আছে। পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে থাকাকালে মালদ্বীপের অর্থের বিষয়ে অডিট হলে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এবার অভিযোগ উঠেছে, লন্ডন হাইকমিশনে রাষ্ট্রের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন তিনি। তাই এখন নতুন করে সরকারি অডিট আপত্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে মিজারুল কায়েসকে। অডিট আপত্তিতে ঢাকা থেকে মালামাল পরিবহনের খরচ দুই দফা আদায় করা, গৃহকর্মীকে মিশনে নিয়োগ দেওয়া, গাড়ি মেরামতে বেহিসাবি ব্যয়, টেন্ডার ছাড়াই ভবন মেরামত, খরচের বা মালামালের রেজিস্টার না রাখা, সরকারি ক্রয়বিধি না মানা, আয়ের সঠিক পরিসংখ্যান না রাখা, ওয়েজ আর্নার্সের টাকা নিয়ম না মেনে খরচ করাসহ প্রভৃতি অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর অভিযোগটি হচ্ছে, কিছু খরচের হিসাবই না রাখা এবং বাজেটের সীমা অতিরিক্ত 'নিয়ন্ত্রণহীন' ব্যয় করা। জানা যায়, মহাজোট সরকারের শেষ বছরে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব থেকে যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হয়ে যান মিজারুল কায়েস। তার দায়িত্ব পালনকালে লন্ডনে হাইকমিশনের অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকার প্রধান নিরীক্ষকের কার্যালয়ের ২০১২-১৩ অর্থবছরের চূড়ান্ত অডিটে মোট ৫৭টি আপত্তি তোলা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে, সরকারি বিধি লঙ্ঘন এবং অনুমোদন ছাড়া ব্যয় করা বিপুল অঙ্কের টাকা ফেরত নিতে। ৫৭ আপত্তির মধ্যে মাত্র ১০টির নিষ্পত্তি করা হলেও ৪৭টি অনিষ্পন্ন আছে। মিশন যেসব জবাব দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের অডিট কার্যালয়। অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হাইকমিশনের কাঠামো অনুসারে স্থানীয় ১৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে সেখানে মোট ২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের দুই গৃহকর্মীকে মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেয়ারটেকার দীন ইসলাম ও ক্লিনার শিপন মিয়াকে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেন হাইকমিশনার। এর মধ্যে দীন ইসলামকে পরিশোধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৮৫ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৭ লাখ ২ হজার ৯০০ টাকা প্রায়। ক্লিনার শিপন মিয়াকে দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহকর্মীকে মিশনে নিয়োগ দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন। কারণ, রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোনো কর্মকর্তা নিজের জন্য সরকারি খরচে নেওয়া কোনো গৃহকর্মীকে মিশনে বা মিশনের বাসভবনে স্থানীয় ভিত্তিক পদে নিয়োগ করতে পারবেন না। গৃহকর্মী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্ত থাকবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাদের বেতন-ভাতার খরচ বহন করবেন। সে জন্য আলাদা ভাতার ব্যবস্থা আছে সরকারিভাবেই। অন্যদিকে, ঢাকা থেকে মালামাল পরিবহনের জন্য অগ্রিম টাকা নেওয়ার পরও ২ হাজার ২৫০ কেজি ব্যক্তিগত মালামাল পরিবহনের জন্য দ্বিতীয় দফায় ৪ হাজার ৩৭৫ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৪ টাকা তুলেছেন মিজারুল কায়েস। অডিট প্রতিবেদনে এ অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আসা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়েছে। আবার, হাইকমিশনের চ্যান্সারি ও বাংলাদেশ হাউসের মেরামতের বিষয়েও আপত্তি তোলা হয়েছে অডিট প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ক্রয়নীতি উপেক্ষা করে মিশনের মালি শাহ মোহাম্মদ বেলালের প্রতিষ্ঠানকে কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়া কাজ দেওয়া হয়েছে। অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে মিশনের কর্মচারী বেলালের নামে প্রায় দেড় কোটি টাকার অর্থ দেওয়া হয়েছে। অডিট দলের পক্ষ থেকে চাওয়া হলেও মিশনের আসবাব রেজিস্টার, বিশেষ রেমিট্যান্স রেজিস্টার, ভ্রমণ ভাতা অগ্রিম রেজিস্টার, আবাসিক টেলিফোন রেজিস্টার, ছুটি রেজিস্টার, চিকিৎসা রেজিস্টার, ওভারটাইম রেজিস্টার, বেতন-ভাতা সংক্রান্ত রেজিস্টার, উৎসব ভাতা সংক্রান্ত রেজিস্টার, অন্যান্য মেরামত সংক্রান্ত রেজিস্টার, ডেড স্টক রেজিস্টার উপস্থাপন করেনি হাইকমিশন। গাড়ি মেরামতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেছে অডিট কার্যালয়। বলা হয়েছে, মিশনের সাতটি গাড়ি মেরামতে ১৯টি ভাউচারের মাধ্যমে ১৮ হাজার ২০০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই গাড়ি মাসে একাধিকবার মেরামতের বিল উত্থাপনসহ স্বল্পসময়ের ব্যবধানে এসব গাড়ি বারবার মেরামত করা হয়েছে। গাড়ি অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি না কিনে অযথা একই গাড়ি বারবার মেরামতে প্রচুর অর্থ অপচয় করা হয়েছে বলে মনে করে অডিট কার্যালয়। এ ছাড়া কনস্যুলার সেবা প্রদানের মাধ্যমে হাইকমিশনের আয়ের হিসাবও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে যথাস্থানে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সে হিসাব ঠিকভাবে রাখা হয়নি। আবার ওয়েজ আর্নার্স তহবিলের টাকা নিয়ম না মেনে খরচ করার কথা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ধরনের অডিট প্রতিবেদনের মুখোমুখি হতে হয় সব কূটনীতিককেই। অনেক ক্ষেত্রে অডিট দলের পক্ষ থেকে অহেতুক অভিযোগও তোলা হয়। কারণ, বিদেশে কূটনৈতিক মিশন চালাতে একেক স্থানে একেক ধরনের পরিবেশে ব্যয়ের হিসাবটাও ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েসের বিষয়ে আপত্তিটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বলেও মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, এগুলোর নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এদিকে, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসকে যুক্তরাজ্য থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গত সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদিত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, দ্বিতীয় দফায় নতুন সরকারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনো অভিনন্দনবার্তা আনতে না পারা এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে সন্তোষজনক সম্পর্ক না রাখার কারণে তাকে হাইপ্রোফাইল লন্ডন হাইকমিশন থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর