কোটা সংস্কারের দাবিতে গতকালও রাজধানীসহ সারা দেশে রাজপথে ছিল শিক্ষার্থীরা। ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা রাজপথে অবস্থান নেওয়ায় অচল হয়ে পড়ে গোটা রাজধানী। এ অচলাবস্থা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেন, ১০ শতাংশের বেশি কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গতকাল বিকালে জাতীয় সংসদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার ঘোষণার পরই আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এর আগে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সরকারকে দ্রুত যৌক্তিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সকাল থেকেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কর্মসূচিতে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবস্থান নেন কলা ভবনসহ বিভিন্ন অনুষদের ফটকে। দেয়ালে দেয়ালে টানিয়ে দেওয়া হয় দাবি আদায়ের পক্ষে নানা পোস্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে খণ্ড খণ্ড, কখনো বিশাল মিছিল সমস্ত ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এরপর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জমায়েত হন তারা। পোস্টার-ফেস্টুনসহ দাবি আদায়ে চলে নানা স্লোগান। টিএসসি এলাকায়ও অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। ঢাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইডেন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও কোটা সংস্কারের দাবিতে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে। আন্দোলনরতরা দুপুরে সাফ জানিয়ে দেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো ক্লাস কিংবা পরীক্ষা নয়। শিক্ষার্থীরা আরও জানান, আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। কোটা আন্দোলনের কারণে আমরা পরীক্ষা বর্জন করেছি। আমার বোনের রক্তের ওপর দিয়ে আমরা পরীক্ষার হলে বসতে পারি না। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান জানান, সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশের বেশি কোটা কোনোভাবেই রাখা যাবে না। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না আসা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
একই দাবিতে রাস্তায় নামেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। ইংলিশ রোড ও জনসন রোডে তাদের অবস্থান নেওয়ার কারণে স্থবির হয়ে পড়ে পুরান ঢাকার পুরো এলাকা। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধ করে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থান রাজধানীর পান্থপথ, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, বনানী, রামপুরা, ফার্মগেট ও মিরপুরসহ বিভিন্ন সড়কে বন্ধ থাকে সব ধরনের যান চলাচল। শিক্ষার্থীদের অবরোধ করা সড়ক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। এতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীবাসীর জীবন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গ্রিন রোড ও পান্থপথ মোড় অবরোধ করেন। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা তাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, অতি দ্রুত কোটা সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় আন্দোলন চলবে। ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার তীব্র নিন্দাও জানান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
কাকরাইল-মগবাজার যান চলাচল বন্ধ : কাকরাইল মসজিদ মোড় থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত যান চলাচল ছিল পুরোপুরি বন্ধ। ওই সড়কে মগবাজার মোড় আসতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টার বেশি। এই পথে উল্টো দিকে যেতে পুরো রাস্তা ছিল ফাঁকা। অর্থাৎ মগবাজার থেকে রমনা থানা হয়ে বেইলি রোডে পুরো সড়কেই ফাঁকা থাকায় শত শত যাত্রীরা হেঁটেই গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। উল্টো দিকে মগবাজার আসতে রাস্তায় অনেকেই গরমে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। মগবাজার মোড়ের আগে সাতরাস্তা যাওয়ার ফ্লাইওভারে ওঠার মুখ পর্যন্ত ছিল তীব্র যানজট। হাতিরঝিল মুখ থেকে গুলশান ঢোকার রাস্তায় ছিল প্রায় বন্ধ। মগবাজার মোড় থেতে গুলশান এক নম্বর মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লেগেছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
দরজা বন্ধ করে গান শুনেন ড্রাইভার-হেলপার : বিকাল ৪টায় জাহাঙ্গীর গেটের আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সামনে একটি নতুন রং করা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটিতে বাংলা সিনেমার গান বাজছে। সামনের সিটে পাশাপাশি হেলপার ও ড্রাইভার বসে সেই গানে তাল দিচ্ছিলেন। সামনে এগোনোর যখন আর কোনো উপায় ছিল না, তখন বিনোদনে গা ভাসিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন তারা। ঘণ্টাখানেক এক জায়গায় অপেক্ষা করার পর যাত্রীরা যখন বুঝতে পেরেছে গাড়ি আর যাবে না, তখন এক এক করে সব যাত্রী নেমে যান। সব শেষে নামেন বাবুল নামে এক যাত্রী। সঙ্গে স্ত্রী ও ছোট শিশু। প্রচণ্ড গরমে শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে স্ত্রীকে বললেন, হাঁটো আমার সঙ্গে। হেঁটে হেঁটেই তাদের বাড্ডা পৌঁছাতে হবে। গতকাল এ রকম পায়ের ওপর ভরসা করেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে পথে নামা যাত্রীদের। প্রচণ্ড গরমে ঘামে ভিজে হাঁটতে হয়েছে ঘিঞ্জি ফুটপাথের ওপর দিয়ে। শিশু, নারী বৃদ্ধ কিংবা যুবক সবারই এক অবস্থা। পল্টন থেকে কোনোভাবে সিএনজি নিয়ে শাহীন নামে এক যাত্রী ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তারপর বসে আছেন তো বসেই আছেন। পরিস্থিতি এমন যে সিএনজিটির ডানে কিংবা বায়ে কোথাও নড়ার মতো পরিস্থিতি নেই। গাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরেক গাড়ি। জিজ্ঞেস করার পর গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এই ব্যবসায়ী জানালেন, জরুরি কাজে টঙ্গীতে তার কারখানায় যাওয়ার কথা। তিনি পৌঁছাতে পারলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা হবে। কিন্তু আজ আর সম্ভব না বলে হতাশা প্রকাশ করলেন এই ব্যবসায়ী। এই যানজটেও ফাঁকফোকর গলে মোটরসাইকেলগুলো এগিয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বনানী এসে থেমে যেতে হয়েছে। কেউ কেউ বনানী থেকে বাঁয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে মিরপুর দশ নম্বর হয়ে কালশী ফ্লাইওভার দিয়ে বসুন্ধরা কিংবা উত্তরা টঙ্গীর দিকে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু যাদের বাইক ছিল না, তাদের জন্য গতকাল একমাত্র অবলম্বন ছিল দুটো পা...।
নানা স্লোগানে মুখরিত রাজু ভাস্কর্য : ‘বাজেটের পরে কোটা সংস্কার মানবো না, মেধা আমার অধিকার-আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, আন্দোলন চলছে—চলবে, নো-মোর টরচার, আর নয় কোটার জয়— এবার হবে মেধার জয়, ম-তে মতিয়া তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, ইনুর চামড়া খুলে নিব আমরা’ এমন নানা স্লোগানে এবং প্ল্যাকার্ডে উত্তাল ছিল রাজু ভাস্কর্য চত্বর। আন্দোলনকারীরা তাদের পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে। সরকারি নিয়োগে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, কোটার যোগ্য প্রার্থী না পেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অভিন্ন বয়সসীমা, নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সংহতি : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি যৌক্তিক উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। গতকাল বেলা ১২টার দিকে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এরপর তিনি রাজু ভাস্কর্যে আন্দোলনরতদের কাছে গিয়ে সংহতি জানিয়ে আসেন। উপাচার্য বলেন, আমাদের মেয়েরা-ছেলেরাই কিন্তু রাস্তায়। কোটা সংস্কারের এই দাবির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সংহতি প্রকাশ করে আমরা সরকারকে বলেছি, দ্রুত একটি ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা হোক। কারণ, তাদের পরিবার, পিতা-মাতার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আছে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও তাদের দায়বদ্ধতা আছে। তারা কখনো ক্লাস বা পরীক্ষা বর্জন করেনি। শুধু কোটা সংস্কারের আন্দোলনে গিয়ে তারা এই বক্তব্যগুলো দিয়েছে এবং কিছু যৌক্তিক সংস্কারের কথা বলছে। যুগের সঙ্গে এই পরিবর্তনটা খুবই জরুরি। উপাচার্য বলেন, সংস্কার এমন একটি বিষয় যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে যায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো স্থবির অবস্থায় থাকে না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে সবসময় সংস্কারকে স্বাগত জানানো হয়। আমরা একেবারেই যৌক্তিকভাবে মনে করি যে সংস্কারের খুবই প্রয়োজন।
ঢাবি শিক্ষক সমিতির সমর্থন : গতকাল দুপুরে সরাসরি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের কাছে তাদের দাবির প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। দুপুর দেড়টার দিকে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির একটি দল একাত্মতা প্রকাশ করেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন ব্যক্ত করছি। কোনো উসকানিতে যেন তোমাদের ন্যায্য দাবি না হারিয়ে যায়। সে আহ্বান জানাই। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ক্যাম্পাসে কোনো ঝামেলা হলে সেটা আমরা শিক্ষক-ছাত্ররা দেখব। পুলিশ যেন হামলা না করে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, অধ্যাপক জিয়াউর রহমান ও সহকারী অধ্যাপক নীলিমা আকতার।
ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন : আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। কোটা সংস্কারের সঙ্গে আমরা সহমত। চাকরি হবে মেধাবীদের। আমরা আগে ছাত্র, পরে লীগ। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ।
এ সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ২০ দলের প্রতিনিধি দলের সমন্বয় করেছিল ছাত্রলীগ। ঢাবির ভিসির বাড়িতে যারা ভাঙচুর করেছেন তাদের বিচার চেয়েছি। আন্দোলনকারীদের বিচার চাইনি।
ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিল : সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে ছাত্রলীগ। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই মিছিল করা হয়। মিছিলটি মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু হয়ে টিএসসি ঘুরে ভিসি চত্বর হয়ে ডাকসুর সামনে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও খবর—
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা গতকাল দিনভর ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে চলে এ অবরোধ। এরপর সন্ধ্যা ৬টায় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অতর্কিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক ছেড়ে যান। জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম ও শিক্ষক সমিতির উপস্থিতিতে এই হামলা চালানো হয়। এদিকে দিনব্যাপী এ অবরোধে দেশের উত্তরাঞ্চল ও বরিশাল বিভাগের সঙ্গে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, জাবি শাখার ব্যানারে সকাল ৯টায় জাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে হাজির হয়। এ সময় তারা পুলিশকে ধাওয়া করলে সাভার ও আশুলিয়া থানা ইউনিটের শখানেক পুলিশ জলকামান ফেলে রেখেই নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এক সময় তা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা গেট সংলগ্ন রাস্তা থেকে শুরু করে প্রধান ফটক ও মীর মশাররফ হোসেন হল পর্যন্ত রাস্তায় পাঁচ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অবস্থান নিয়ে কোটা প্রথা সংস্কারে দিনভর স্লোগান দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-রাজাশাহী মহাসড়কে জনসমুদ্রের জোয়ার উঠেছিল গতকাল। সবারই একটাই দাবি ছিল, ‘কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চাই’।
এ দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে এ আন্দোলন।
খুলনা : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গতকালও উত্তাল হয়ে ওঠে খুলনা। দুপুরে নগরীর শিববাড়ীর মোড়ে চাকরিপ্রার্থী হাজার হাজার বেকার তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। এ সময় শিববাড়ী মোড়ের আশপাশের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে সকালে একই দাবিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে মিছিল করে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অবস্থান নেন। পরে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে খুলনার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শিববাড়ী মোড়ে অবস্থান নেন। এখানে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), সরকারি বিএল কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেন।
সিলেট ও শাবি : কোটা সংস্কারের দাবিতে গতকাল শিক্ষার্থীদের দখলে ছিল সিলেটের রাজপথ। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে মিছিল করেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, লিডিং ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, এমসি কলেজ, মদন মোহন কলেজের শিক্ষার্থীরা চৌহাট্টা পয়েন্ট অবরোধ করেন। তাদের সঙ্গে শাবির অনেক শিক্ষার্থী যোগ দেন। তাদের অবরোধে চৌহাট্টা থেকে জিন্দাবাজার সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে অন্যান্য সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : গতকাল সকাল ১০টা থেকে ক্লাস বর্জন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে এবং কোনো বিভাগে ক্লাস হয়নি। আন্দোলনকারীরা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মহাসড়কে অবস্থান নেন। ফলে রাস্তার দুই পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
দিনাজপুর : দিনাজপুর-রংপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শত শত শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বর্জন করে মহাসড়কে অবস্থান নেন। সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনের দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করেন।
কুমিল্লা : একই দাবিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (কুবি) বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গতকাল উত্তাল ছিল নগরীর কান্দিরপাড়। সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে অবস্থান নেন কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে। দফায় দফায় নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এতে নগরীর পুলিশ লাইন, টমছমব্রিজ, রানীর বাজার ও রাজগঞ্জ সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
বরিশাল : এ দাবিতে গতকাল ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা সকাল সোয়া ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনের মহাসড়ক অবরোধ করেন। ফলে যাত্রী সাধারণের চরম দুর্ভোগ হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সার্ভিসের যানবাহন নিরাপদে পাড় করে দেওয়া হয়। দুপুর আড়াইটার পর জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। অপরদিকে একই দাবিতে ক্যাম্পাসের সামনে সড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিএম কলেজ এবং শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ময়মনসিংহ : গতকাল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে জমায়েত হন। সকাল ১০টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মুক্তমঞ্চের সামনে এসে শেষ হয়। পরে পৌনে ১টা থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে রেল সড়ক অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলসড়কে ময়মনসিংহগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেন ফাতেমা নগর স্টেশনে আটকা পড়ে।
যশোর : কোটা সংস্কার দাবিতে যশোরে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা গতকাল অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ করেছেন। তারা মুজিব সড়কে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে একই দাবিতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) অবস্থান কর্মসূচি পালন ও উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা।
জামালপুর : একই দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী প্রথমে কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। পরে পাঁচ রাস্তার মোড়ে সড়ক অবরোধ করলে প্রায় এক ঘণ্টা ওই সড়কে যোগাযোগ ব্যাহত হয়।
ঝিনাইদহ : কোটা সংস্কার দাবিতে গতকাল ঝিনাইদহের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের বাদানুবাদ ও ধস্তাধস্তি হয়েছে। সকাল থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও কেসি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঝিনাইদহ শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের শহীদ মিনার চত্বরে কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশে বাধা দেয়। এ সময় ধস্তাধস্তি ও বাদানুবাদের এ ঘটনা ঘটে।
চুয়াডাঙ্গা : মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের দাবিতে গতকাল চুয়াডাঙ্গায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। সকালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চুয়াডাঙ্গা ইউনিট কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চুয়াডাঙ্গা ইউনিট যৌথভাবে এ কর্মসূচি পালন করে।
টাঙ্গাইল : মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
গাজীপুর : গাজীপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গতকাল বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন। বিক্ষুুব্ধ শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ কয়েকটি সড়ক অবরোধ করেন। এতে দীর্ঘ যানজটে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জে সাধারণ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে সরকারি গুরুদয়াল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে মিছিলটি শুরু হয়। এটি পুরাতন স্টেডিয়ামের সামনে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করলে পুলিশ পিছন দিক থেকে লাঠিচার্জ করে। এ সময় ছাত্ররাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পরে ছাত্ররা সংগঠিত হয়ে আবারও মিছিল নিয়ে গুরুদয়াল কলেজে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন।
নেত্রকোনা : কোটা সংস্কার দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নেত্রকোনার ব্যানারে গতকাল বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। পৌরসভার সামনের প্রধান সড়কে এ কর্মসূচিতে জেলা উপজেলার সাধারণ ছাত্ররা অংশ নেয়। এর আগে প্রেস ক্লাব সড়কেও তারা বিক্ষোভ করেন।