বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী পদক্ষেপকে অভিনন্দন

মাহমুদ আজহার

প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী পদক্ষেপকে অভিনন্দন

ড. আকবর আলি খান

কোটা বাতিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোটা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই। অনেক দিন আগেই এটা প্রয়োজন ছিল। কোনো সরকারই এটা নিয়ে কিছু করতে সাহস পায়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপকে আমি অভিনন্দন জানাই।’

গতকাল বিকালে গুলশানে নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ সময় তিনি কোটা প্রথা চালুর পেক্ষাপটসহ বাংলাদেশের সংবিধানে এর অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার তিনটি গণপ্রশাসন সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছিল। একটি কমিশন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কমিশনটির নাম মোজাফফর আহমদ চৌধুরী কমিশন। দ্বিতীয় কমিশন করেছিলেন জিয়াউর রহমান সরকার। ওই কমিশনের নাম ছিল রশিদ কমিশন। আর তৃতীয় কমিশনটি করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেটির নাম ছিল এ টি এম শামসুল হক কমিশন। এই তিনটি কমিশনই কোটা একেবারে তুলে দেওয়ার জন্য বলেছে। এটা হলো বিশেষজ্ঞদের মত। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখনই কোটাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। কোটা থাকতে পারে আরও কিছুদিন। কিন্তু চিরস্থায়ীভাবে কোটা প্রবর্তন করা যাবে না। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন জেলা কোটা প্রবর্তন করেন, তখন এটা স্পষ্ট অনুমান করা হয়েছিল, ১০-১৫ বছরের মধ্যে কোটা উঠে যাবে।’ বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কোটা প্রথা চালুর জন্য যিনি স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনি ছিলেন সংস্থাপন সচিব মাহবুবুর রহমান। মোজাফফর আহমদ কমিশনের সদস্যও ছিলেন তিনি। যখন কমিটির সদস্যরা কোটা তুলে দেওয়ার জন্য অভিমত প্রকাশ করেন, তখন তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, আর কিছুদিন কোটা চালু থাকতে পারে। তারপর জেলা কোটা তুলে দেওয়া হবে। সুতরাং কোনো কোটাই চিরস্থায়ী হতে পারে না। এ অবস্থায় যা দরকার, তা হলো কোটায় সংস্কার করতে হবে। আদর্শ কত তা নির্ধারণ করা মুশকিল। আমি আমার ‘‘গ্রেশাম’স ল সিনড্রম অ্যান্ড বেয়ন্ড’’ বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছি। সব সুপারিশ এখন বলা মুশকিল।’ কোটা সংস্কার নিয়ে গত কয়েক দিনের সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনকে কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে করেন—এমন প্রশ্নে ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘এ নিয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনকে আমি যৌক্তিক মনে করি। বাংলাদেশে যে ধরনের কোটাব্যবস্থা এখন চালু রয়েছে, তা উদ্ভট ব্যবস্থা। পৃথিবীর কোথাও ২৫৮টি কোটা নেই। এসব কোটার জাঁতাকলে বাংলাদেশে মেধার প্রাধান্য নেই। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ ভাগ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র ৪৫ ভাগ পদে নিয়োগ হয় মেধার ভিত্তিতে। আরও ১ শতাংশ কোটা আছে, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের। সেটি বাধ্যতামূলক নয়। এক অর্থে ৫৬ শতাংশও বলা যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘৫৫ শতাংশই যদি দেখেন, সেটা সংবিধানসম্মত নয়। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। তারপর বলা হয়েছে, এই মেধার নিয়ম ব্যতিক্রম করা যেতে পারে, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন আইনের সাধারণ নিয়ম হলো, সাধারণ কোনো নীতির চেয়ে ব্যতিক্রমী নীতি বেশি হতে পারে না। আমাদের দেশে সংবিধানে এই বিধানটি যে ভাষায় দাঁড়ি-কমাসহ লেখা হয়েছে, তা ভারতের সংবিধানের অনুকূলে। সুতরাং ভারতে এই সংবিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ওই দেশটির সুপ্রিম কোর্ট যে ধরনের রায় দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।’

ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘জেলা কোটা তুলে দেওয়া যেতে পারে। তবে সরকার যদি মনে করে, জেলা কোটা তুলে দিলে কোনো কোনো অঞ্চলে ভুল ধারণা হতে পারে, তাহলে বিভাগীয় পর্যায়ে কোটা চালু করা যেতে পারে। এতে ২৫৮ থেকে কোটা নেমে আসতে পারে ৩৭-এ। সে ধরনের কোটা সরকার ইচ্ছা করলে বাস্তবায়ন করতে পারে। যদি সম্ভব হয় একেবারেই জেলা কোটা তুলে দেওয়া উচিত। না হলে সেটা বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যেতে পারে। এর কারণ হলো, ৬৪টি জেলার জন্য কোটা করা সম্ভব নয়। এখন কেউ যদি বলে, উপজেলা ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হবে, এটা সম্ভব নয়। আপনি কি সেই ৪৮০টির জন্য ২০০০ কোটা করবেন নাকি? সেটা সম্ভব নয়। এখন ইউনিয়ন কাউন্সিল ভিত্তিতেও কোটা চাইতে পারে। সেটা তো সম্ভব নয়। এটারও প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। আর মহিলা, উপজাতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকতে পারে।’

মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার কোটা কী জন্য আছে তা আমাদের বুঝতে হবে। কোনো পুরস্কার দেওয়া জন্য কোটা থাকতে পারে না। আমাদের সংবিধানে অনগ্রসর জাতির জন্য কোটা দেওয়ার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে কোটা দেওয়া হয়েছে। তারা কীভাবে অনগ্রসর? তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখাপড়া করতে পারেনি, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা মানসিকভাবে অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে অন্য যারা ভালোভাবে লেখাপড়া করেছেন, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা তাদের সম্ভব হয়নি। সে জন্য তাদের আলাদা কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন আর কোনো মুক্তিযোদ্ধার চাকরিতে যোগদান করার বয়স নেই। এখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিদের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটার পক্ষে একটা যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, যেহেতু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করতে পারেনি, তাই তাদের সন্তানরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এবং তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও এ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর কোনো কোটা সংরক্ষণ রাখা সঠিক হবে বলে আমি মনে করি না।’ ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘সব মুক্তিযোদ্ধাই কিন্তু ১৯৭২ সালের মতো অনগ্রসর জাতি নয়। এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, তারা অনেক সচ্ছল। তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা দেওয়া ঠিক হবে না। যারা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা তাদের জন্যই এটা করা যেতে পারে। এটা নিরূপণ করার উপায় আছে, বাংলাদেশ সরকার যেসব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করে এবং যাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেওয়া হয়, তাদের সন্তানদের জন্য কোটা দেওয়া যেতে পারে। এদের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ হতে পারে। তাদের জন্য ১০ বছর এ সুবিধা রাখা যেতে পারে। অন্যদের জন্য এ সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না।’ সাবেক এই অর্থসচিব বলেন, ‘এ ধরনের ব্যবস্থা ভারতেও দলিত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। ওই দেশের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, অনগ্রসর জাতির ওপরে যারা রয়েছেন, তাদের কোটা দেওয়া যাবে না। সেই ভিত্তিতে বাংলাদেশেও সংস্কার করা যেতে পারে। আর একবার সংস্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। যেহেতু কোটাব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়, তাই ৫-১০ বছর পর মূল্যায়ন করতে হবে, কোটার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। আর শুধু কোটার আইন পরিবর্তন করলেই বাংলাদেশের মেধাবীরা চাকরি পাবে এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিসিএস ছাড়াও সরকারি অন্যান্য পরীক্ষা হচ্ছে, সেখানেও বহু ধরনের সমস্যা হচ্ছে। সুতরাং পরীক্ষা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। পরীক্ষকদেরও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এসব করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী পাবলিক সার্ভিস কমিশন। শুধু কোটার সংস্কার করেই এর সমাধান করা যাবে না।’

সর্বশেষ খবর