শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশ বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশ বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

বগুড়ায় তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশ বদলে দিতে পারে এ অঞ্চলের অর্থনীতি। অর্থনীতির গতি বাড়িয়ে বগুড়া জেলাকে আবারও নতুন করে দিতে পারে নতুন শিল্পের পরিচয়। সৃষ্টি হতে পারে আরও বেকারদের কর্মসংস্থান। কিন্তু ভিনদেশি পণ্যের প্রবেশ, সঠিক তদারকি না হওয়া, সরকারি সহযোগিতা না থাকা, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ার কারণে বগুড়ার কৃষিশিল্প মালিকদের মধ্যে অনীহার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বগুড়ার বিসিকসহ জেলাজুড়ে আনাচেকানাচে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় শিল্পটি সঠিক তদারক করা হলে কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেনের পাশাপাশি সৃষ্টি হবে লক্ষাধিক বেকারের কর্মসংস্থান। জানা যায়, বগুড়ায় উৎপাদিত হাজার হাজার কৃষিপণ্য ব্যবহূত হচ্ছে কৃষিকাজে। এর সঙ্গে কিছু ওয়ার্কশপে কৃষিকাজে ব্যবহার করা ছাড়াও বাসাবাড়ি, বাস-মিনিবাস, ছোট-বড় ইন্ডাস্ট্রি ও বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কলকারখানায়   ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশও তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শ্যালো ইঞ্জিনের সেচপাম্প, লায়নার, পিস্টন, হস্তচালিত টিউবওয়েল, পাওয়ার টিলারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিন, গাড়ির ব্রেক ড্রাম, করাতকল, ফ্লাওয়ার মিল, টেক্সটাইল মিল, অয়েল মিল, এমনকি ধান কাটা মেশিনসহ অন্যান্য মেশিনের যন্ত্রাংশ। এসব যন্ত্রাংশের ওপর দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। বগুড়ায় তৈরি এই যন্ত্রাংশগুলো জেলার কৃষিকাজের চাহিদা মিটিয়ে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিকাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এই শিল্পের বড় সমস্যা ভিনদেশি পণ্য আর কাঁচা মালামালের বাজারের অস্থিরতা। বিদেশি পণ্য ঠেকানো গেলে ও অস্থিরতার স্থায়ী সমাধান হলে জেলার এই শিল্পের চাকা আর্থিকভাবে দ্বিগুণ ঘুরত।

বগুড়া বিসিকের কর্মকর্তরা জানান, স্বাধীনতার আগে বগুড়ায় বিভিন্ন যন্ত্রের খুচরা পার্টস তৈরি শুরু হয়। বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় বিসিক শিল্প ও কাটনারপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এই কৃষিকাজের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। জেলার কারখানাগুলোয় তৈরি কৃষিপণ্য বগুড়াসহ উত্তরের ১৬ জেলায় ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি করে। এ কারণে বগুড়া বিসিকে শিল্প প্লটের চাহিদা বাড়তে থাকে। ১৯৮০ সালে বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্প প্লট শেষ হয়ে যায়। পরে এই শিল্পের বিকাশ বেড়ে যাওয়ায় বেশকিছু প্রতিষ্ঠান শহরের ফুলবাড়ী, গোহাইল রোড, রেলওয়ে মার্কেট, শাপলা মার্কেট, কাটনারপাড়া, চারমাথা এলাকায় গড়ে উঠেছে। এসব কলকারখানায় তৈরি বিভিন্ন ধরনের পার্টস ব্যবহূত হয় বাসাবাড়ি, কারখানায় ও কৃষিকাজে। দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প। এ শিল্পের সঠিক তদারক করা হলে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বগুড়া শহরের রেলওয়ে হকার্স মার্কেটের বসাক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের প্রোপ্রাইটর বিশ্বজিৎ বসাক বলেন, তিনি লায়নার, পিস্টনসহ শ্যালো মেশিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি ও পাইকারি বিক্রি করেন। তিনি মাসে যা আয় করেন তা দিয়ে তার পরিবারের ভরণপোষণ চলছে। তার মতো এমন আরও অনেকেই আছেন, যারা এ কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজুর রহমান মিল্টন বলেন, আশির দশকে ব্যক্তি উদ্যোগে বগুড়াতেই প্রথম ফাউন্ড্রি শিল্পের কারখানা গড়ে ওঠে। বগুড়ায় ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬২টি। এর সঙ্গে আরও কিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর ফাউন্ড্রি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কশপ রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারের মতো। বগুড়ার কারখানায় অন্তত ৮০ ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। এর মধ্যে ফাউন্ড্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বেশকিছু ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ছোট-বড় কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। ফাউন্ড্রি শিল্পে মালিক-শ্রমিক নিজেদের তাগিদে কাজ করে যাচ্ছেন। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলে আরও প্রসার যেমন হবে, তেমনি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মালেক আকন্দ বলেন, গার্মেন্টের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে এই ফাউন্ড্রি শিল্প। একই সঙ্গে এই শিল্প দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। বর্তমানে সারা দেশে কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি ও মেটাল শিল্পের মালিকরা। শ্যালো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, যানবাহনের ছোট পার্টস, কলকারখানার প্রয়োজনীয় পার্টসসহ কৃষির সব যন্ত্রাংশ বগুড়ায় তৈরি হয়। কৃষির জন্য পাওয়ার টিলারের লোহার চাকা, শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, মেশিনের যন্ত্র পিস্টন, গজল পিন, লাইনার হেডপিট তৈরি হচ্ছে। বগুড়ায় কিছু গাড়ির ব্রেক ড্রাম তৈরি হচ্ছে, যা দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। শহজ শর্তে ঋণ প্রয়োজন। শিল্পমালিকদের এসব দেওয়া হলে বগুড়ার এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। প্রতি বছর এ খাত থেকে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়। আর সেখানে শিল্পমালিকদের ততটা সহযোগিতা করা হচ্ছে না। কিছু কিছু বিদেশি পণ্য দেশে আসছে। বিদেশি কৃষিপণ্য প্রবেশ কঠোর করা হলে দেশে তৈরি এই কৃষিপণ্য ও ফাউন্ড্রির পণ্য আরও বেশি চাহিদার সৃষ্টি করত। চাহিদা পূরণে তখন জনবলও প্রয়োজন হতো। দেশের অর্থনীতি অগ্রগতির সঙ্গে বেকারদের কর্মসংস্থানও হতো। কিন্তু একশ্রেণির ব্যবসায়ী নিজস্ব প্রযুক্তিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কারণে-অকারণে এই শিল্পের কাঁচামাল পিগ আয়রন, জাহাজভাঙা লোহা, হার্ড কোকের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। গত তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে হার্ড কোক ৩৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৫৩ হাজার টাকা টনে দাঁড়িয়েছে। পিগ আয়রন আমদানি করতেই পড়ে যাচ্ছে টনপ্রতি ৫৮ থেকে ৬০ হাজার টাকা, যা আগে পড়ত ৩৬ থেকে ৪০ হাজার টাকা। শিপ ব্রেকিং লোহার দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে এ শিল্পের ক্ষতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে। এ শিল্পকে আরও অগ্রসর করতে হলে কাঁচামাল ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে ভিনদেশি পণ্য নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

বগুড়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন জানান, বগুড়ায় তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশের সারা দেশে সুনাম রয়েছে। চাহিদাও অনেক। বগুড়ায় উৎপাদিত এসব পণ্য কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে কৃষির সমস্যা কমিয়ে ফলন বেড়েছে। খরচ কমেছে। আধুনিক স্তরে কৃষির প্রবেশগম্যতা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। বগুড়ার শিল্পমালিকদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হয়। এর পরও কিছু সমস্যা থেকেই যায়। যেসব সমস্যা রয়েছে তা পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর