বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিচারকের বিবেচনায় ১৪ পয়েন্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিচারকের বিবেচনায় ১৪ পয়েন্ট

বর্বরোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ে দণ্ড দেওয়ার জন্য ১৪টি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন বিচারক। গতকাল নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে এ রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন। রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, এ মামলায় দণ্ড দেওয়ার বিষয়ে ১৪টি বিবেচ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো— অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধ ও ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আসামি আহসান উল্লাহ কাজলের ভাড়া করা ফ্ল্যাট বাড়ি নম্বর-ম-৩০ পশ্চিম মেরুল বাড্ডার মৃত জয়নাল আবেদিনের তৃতীয় তলার বাড়ির গেরেজসংলগ্ন পূর্ব পাশের তিন কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাট থেকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটনাস্থল ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার জন্য আসামিরা একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয় কিনা ও গ্রেনেড নিক্ষেপকারীরা এই ঘটনাস্থল থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করেছে কিনা।

অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য পরিদর্শক রুহুল আমিনের বাড়ি হোল্ডিং নম্বর ২/৫ আনন্দনগর, বাড্ডা। আসামি মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী ওই বাড়ি ভাড়া নিয়ে অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে জঙ্গি কাজে নিযুক্ত ছিল কিনা। ওই বাড়ি থেকে মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী ২০০৫ সালে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় কিনা। দণ্ড দেওয়ার জন্য মেরুল বাড্ডার রাজউক প্লট নম্বর ৫৩, লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম রাব্বানীর (অব.) চার তলা বাড়ির তৃতীয় তলার উত্তরাংশের ফ্ল্যাট আসামিরা ভাড়া নিয়ে গ্রেনেড সংরক্ষণ করত কিনা এবং বিভিন্ন গ্রেনেড হামলায় ওই বাড়ি থেকে গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়েছে কিনা। এ ছাড়া রোড নম্বর ৫/এ, বাড়ি নম্বর ৬১, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, বাড়িটি বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর দ্বিতল সরকারি বাসভবন। ওই বাসভবনে ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আবদুস সালাম পিন্টু, লুত্ফুজ্জামান বাবর, মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী, আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা তাজউদ্দিনরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে কিনা। ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে গ্রেনেডপ্রাপ্তি, অর্থবল, প্রশাসনিক সহায়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াসহ ২০ আগস্ট আসামি আহসান উল্লাহ কাজল ও মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির বাসা থেকে আসামি মাওলানা তাজউদ্দিনের সরবরাহকৃত ১৫টি আর্জেস গ্রেনেড এবং নগদ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে কিনা।

প্লট নম্বও ৩, সেকশন-১, ব্লক-সি, মিরপুরে মসজিদ-ই আকবর কমপ্লেক্সে আসামি মাওলানা আবু তাহের শিক্ষকতা করতেন কিনা। কমপ্লেক্সের মসজিদের ইমাম সাহেবের অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে জুমার নামাজের সময় মুসল্লিদের উদ্দেশে জিহাদি বক্তব্য দিতেন কিনা। ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট আসামি আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের, আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি মঈন পরিকল্পনা ও অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় শলা-পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করেছে কিনা। ৩/১১ আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেট, সাত মসজিদ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। এ বাড়ির নিচতলায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হতো কিনা। ওই বাড়িতে গ্রেনেড সংরক্ষণ করা হতো কিনা এবং এ মামলার অনেক আসামি ওই বাড়িতে যাতায়াত করত কিনা। আসামিরা দেশের বাইরে ও দেশের ভিতর হামলা পরিচালনার জন্য মাওলানা তাজউদ্দিনের কাছ থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করত কিনা। মাওলানা তাজউদ্দিন বিয়ের পর একই বাড়ির তৃতীয় তলায় বসবাস করত কিনা এবং সেখানে গ্রেনেড সংগ্রহ করত কিনা। ওই বাড়িতে আসামি আবদুস সালাম পিন্টু ও মাওলানা আবু তাহেরের যাতায়াত ছিল কিনা এবং গুলশান থানার লালাসরাই মৌজার রোড নম্বর ১৩, ব্লক ডি, বাড়ি নম্বর ৫৩, বনানী মডেল টাউনের জনৈক আশেক আহমেদ, বাবা আবদুল খালেক। তার বাসাটি হাওয়া ভবন নামে পরিচিত। ওই হাওয়া ভবন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কিনা। ওই ঘটনাস্থলে পলাতক আসামি তারেক রহমান অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে কিনা ও জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিটিং করে কিনা, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয় রায়ে।

বিচারক বলেন, মোহাম্মদপুর থানার আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেট এলাকার সাত গম্বুজ মসজিদে ঘটনার আগে আসামি মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী, মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আবদুর রউফ, আবদুল মাজেদ ভাট অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করার বিষয় এবং মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটের কাছে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর অফিসে ও খিলগাঁও থানা এলাকায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন সময় আসামিরা অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক সভা ষড়যন্ত্র করেছে কিনা, তাও বিবেচনায় নিয়েছেন তিনি।

অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেনেড আক্রমণ চালানোর সুবিধার জন্য ও অপরাধীদের রক্ষার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা এবং অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে মামলার ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত সংরক্ষণযোগ্য তাজা গ্রেনেড আলামত হিসেবে জব্দ করার পরও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে এবং আদালতের অনুমতি না নিয়ে অপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস করার ও আলামত নষ্ট করায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে রায়ে। রায়ে বলা হয়, অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রসংক্রান্ত সভা ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মূল আসামিদের সহায়তা করার লক্ষ্যে আসামিদের নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে ও পরবর্তী সময়ে আসামিদের অপরাধের দায় থেকে বাঁচানোর সুযোগ করে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা এবং প্রকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং তাদের রক্ষা করার জন্য প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অন্য লোকের ওপর দায় বা দোষ চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার লক্ষ্যে মিথ্যা ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা, দণ্ড দিতে সে বিষয়গুলোও বিবেচ্য বিষয় হিসেবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া উল্লিখিত ঘটনাস্থলগুলোয় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পনা করে পরবর্তী সময়ে মূল ঘটনাস্থল আওয়ামী লীগ কার্যালয় ২৩ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনের ঘটনার তারিখ ও সময় আর্জেস গ্রেনেড হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা-কর্মীসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গুরুতর আহত করার অপরাধে আসামিদের দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ১০৯, ২০১, ২১২, ২১৭, ২১৮, ২৩০ ও ৩৪ ধারায় শাস্তি দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে রায়ে।

সর্বশেষ খবর