বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভিকারুননিসা উত্তাল ক্লাস পরীক্ষা বর্জন

মামলা তদন্তে ডিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভিকারুননিসা উত্তাল ক্লাস পরীক্ষা বর্জন

শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিক্ষোভে গতকালও উত্তাল ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ। অরিত্রী আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো এ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন তারা। তাদের আন্দোলনের মুখে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করলেও গত রাতে গভর্নিং বডির  বৈঠকে আগামীকাল শুক্রবার থেকে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অধ্যক্ষসহ অভিযুক্ত তিন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব মহাপরিচালক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে মঙ্গলবার রাতে অভিযুক্ত ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে পল্টন থানার মামলার তদন্তভার গতকাল বিকালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে বিভিন্ন প্লাকার্ড এবং ফেস্টুন হাতে নিয়ে ভিকারুননিসার সামনে অবস্থান নেন। ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে বলেও ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।

শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি হলো—অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসকে বরখাস্ত এবং আত্মহত্যার প্ররোচনার কারণে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় শাস্তি, কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হবে না এমন নিশ্চয়তা প্রদান, কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেওয়া এবং হুমকি বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রত্যেক ক্লাসে মনোবিদের ব্যবস্থা রাখা, গভর্নিং বডির প্রত্যেক সদস্যের পদত্যাগ এবং আন্দোলনকারী কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলে, দিনব্যাপী বিভিন্ন ক্লাসের যে পরীক্ষা ও নিয়মিত ক্লাস হওয়ার কথা রয়েছে সেগুলোতে কোনো শিক্ষার্থী যাতে অংশ নিতে না পারে সে জন্য তারা মূল ফটক অবরোধ করে রেখেছে। তারা দ্রুত দোষী শিক্ষকদের আটক করে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানায়। অভিভাবকরা বলেন, এমন সাইকোলজিক্যালি সিক টিচার কোনোভাবেই স্কুলে থাকতে পারবে না। তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে দেখানো হবে। মেয়ে অরিত্রীকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দিলীপ অধিকারীর করা মামলাটি পল্টন থানা থেকে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘এ মামলায় এখনো কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। মঙ্গলবার রাতে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী মামলাটি করেন।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ফটকে অবস্থান নেয়। সকাল ১০টা থেকে অধ্যক্ষসহ দোষী অন্য শিক্ষকদের বহিষ্কারের দাবিতে থেমে থেমে তারা স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় প্রতিষ্ঠানের সামনে বেইলি রোডে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) বন্ধের সুপারিশও করা হয়। এ শিক্ষকরা হলেন—ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতি শাখার শিফ্ট ইনচার্জ জিনাত আরা ও শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনা। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম-অসঙ্গতিও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না। এটি অপরাধ।’

আজকের পরীক্ষা শনিবার : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির ক্লাস পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলেও গত সন্ধ্যায় গভর্নিং বডির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবারের পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা আগামী শনিবার অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া স্থগিত হওয়া গতকালের পরীক্ষা আগামীকাল শুক্রবার নেওয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতি শাখার শিফ্ট ইনচার্জ জিনাত আরা এবং শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে বহিষ্কার করা হয় গতকালের বৈঠক থেকে। গভর্নিং বডির সদস্য আতাউর রহমান গত রাতে প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানান। শিক্ষক প্রতিনিধি মুশতারী সুলতানা বলেন, অরিত্রী ও তার বাবা অধ্যক্ষের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছেন এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। এটি অসত্য, বানোয়াট।

আন্দোলন চলবে শিক্ষার্থীদের : গতকাল সকাল থেকেই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে অরিত্রীর আত্মহত্যাকে ‘হত্যা’ আখ্যা দিয়ে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। ছাত্রীরা এ সময় ছয়টি দাবি মেনে নিতে বেইলি রোড ক্যাম্পাসের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে আনুশকা রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। অধ্যক্ষ বা মুখপাত্রের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চাই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান চলতে থাকবে।’

নির্দয় আচরণ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ : তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অরিত্রীর বাবা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে এলে তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে। তাদের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে। এই শিক্ষকরা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা করেছেন। বাবা-মার অসম্মান মেনে নিতে পারেনি বলে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। বলা হয়, এর দায় কোনোভাবেই তিন শিক্ষক এড়াতে পারেন না।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নোটিস : গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এক নোটিসে জানায়, অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি গভর্নিং বডির দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় বহন করে।

মামলা তদন্তের নির্দেশ : ছাত্রী আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ায় ভিকারুননিসার তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত করে ৯ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী এ আদেশ দেন। মামলার আসামিরা হলেন— ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষক জিনাত আরা ও শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনা। মামলা সূত্রে জানা গেছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রী অরিত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় মামলা কর হয়েছে। এ মামলা জামিনযোগ্য নয় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর শান্তিনগরের বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে ভিকারুননিসার নবম শ্রেণির প্রভাতি শাখার ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী (১৫) আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ২ ডিসেম্বর বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন জব্দ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ তার বাবাকে স্কুলে ডেকে পাঠায়। পরে তার বাবাকে স্কুলে ডেকে এনে অপমান করা হয়। এই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করে।

সর্বশেষ খবর