শনিবার, ১১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

চারজনে তিনজন হৃদরোগ ঝুঁকিতে

গরমে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, অল্পবয়সীরাও বাদ নেই

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। গত বছরের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওপর এক নীতিনির্ধারণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ তথ্য উঠে আসে। গ্রীষ্মের দাবদাহে বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। আশঙ্কাজনকহারে অল্পবয়সীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়সী প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ইউরোপীয়দের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত বছর আগেই দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি রোগ দেখা দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৫ বছর কিংবা এর চেয়ে বেশি বয়সীর মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, এর অর্ধেকই এ সম্পর্কে সচেতন নয়। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪০ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ১৯৭০ সালের পর উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর হার কমে গেলেও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় হৃদরোগ। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি, কিন্তু গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা ৫৩ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। গ্রীষ্মের প্রচ  গরমের কারণে বাড়ছে হৃদরোগ ঝুঁকি।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বুকের এক পাশে কিংবা চারপাশে ব্যথা অনুভূত হওয়া, বুক ভারী লাগা, শরীরের অন্য অংশ যেমন বাঁ হাতে, পিঠে, চোয়ালে এ ব্যাথা হতে পারে। ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বমি বমি ভাব, বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’

ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. মাহবুবর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পারিবারিক ইতিহাস ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণেই মানুষ আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয় বেশি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছেÑ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত ওজন। বর্তমানে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই পরিস্থিতি প্রায়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট পরিচালিত ব্রেভ স্টাডি (বাংলাদেশ রিস্ক অব অ্যাকিউট ভাসকুলার ইভেন্টস) নামের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১০ সালের পর থেকে হৃদরোগের আক্রমণ হবে দ্বিগুণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ, যার মধ্যে অপরিণত বয়সে ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মারা যাচ্ছে শতকরা ৮০ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ বার্ষিক হেলথ বুলেটিনে বলা হয়েছে, রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) প্রতি বছরই হৃদরোগ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালের হিসাবে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৬৪ হাজার ৯০৬ জন ভর্তি হয়েছেন। আর ২০১৫ সালে বহির্বিভাগে ২ লাখ ২২ হাজার ১৮৬ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৬৩ হাজার ৩৯০ জন ভর্তি হয়েছেন। হৃদরোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এর অন্যতম ধূমপান থেকে বিরত থাকা, মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা, দুশ্চিন্তা না করা, শরীরের রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাচলা করা, ব্যায়াম করা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রচুর শাক-সবজি খাওয়া, নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখা এবং মাঝে মাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

সর্বশেষ খবর