ফ্রীডম পার্টির অস্ত্র আর অর্থ আসত লিবিয়া থেকে। পার্টির জন্য দেশে আনা হয়েছিল অসংখ্য নতুন হুডখোলা জিপ। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় খন্দকার আবদুর রশীদ ও সৈয়দ ফারুক রহমান গড়ে তুলেছিলেন ফ্রীডম পার্টি। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী জঙ্গিবাদী সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ সহযোগিতাও তারা নিয়েছে ফ্যাসিবাদী এই সংগঠন গঠনে। জনশক্তি রপ্তানির নামে তরুণদের লিবিয়ায় নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই তরুণরা দেশে ফিরে ফ্রীডম পার্টির পক্ষে সন্ত্রাসী তৎপরতায় অংশ নেবে- এটাই ছিল ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য। আশির দশকে অস্ত্র আর অর্থের লোভ দেখিয়ে অসংখ্য তরুণকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রীডম পার্টির ফারুক-রশীদ। সে সময় এসব তরুণ প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াত সারা দেশে।
সূত্র জানান, লিবিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ক্যাম্প ছিল। ফারুক- রশীদ ও বজলুল হুদা ট্রেনার ছিলেন। সেই ক্যাম্পেই ঝটিকা আক্রমণের পদ্ধতি থেকে শুরু করে বিমান ছিনতাইসহ ভারী অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। চলত রাজনৈতিক ক্লাস। প্রধান পাঠ্য ছিল গাদ্দাফির ‘গ্রিন বুক’। ত্রিপোলিতে তাদের ছিল একটি অতিথিশালা। প্রথমে সবাইকে সেখানে নেওয়া হতো। এরপর নেওয়া হতো ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা দেশে ফিরেছেন তার মধ্যে অন্যতম শমসের আলম নসু, মাইনু, মজনু, খোকন, পিন্টু, বুলু, আসিফ, স্বপন, ধানমন্ডির তপন, হাজারীবাগের জাভেদ, জালাল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে র পর খুনিরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল লিবিয়ায়। দেশটি পরে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সেকেন্ড হোমে পরিণত হয়। খুনি লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ ও কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের নেতৃত্বে অন্য খুনিরা লিবিয়ায় নিয়মিত বৈঠক করতেন। সূত্র জানান, ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিশেষ বিমানযোগে দেশত্যাগ করেন। তারা প্রথমে ইয়াঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক যান। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে লিবিয়ায় আশ্রয় নেন। লিবিয়া থেকে পরে বেশ কয়েকজন খুনিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ১৯৭৫ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত লিবিয়াকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় সে দেশে লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ ও কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৮০ সালে গড়ে তোলেন ফ্রীডম পার্টি। তবে শুরু থেকেই লিবিয়ায় তারা দুজনই ভিআইপি অতিথির মর্যাদা পেতেন। খন্দকার আবদুর রশীদ ত্রিপোলিতে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেই কোম্পানি গড়ে তোলার জন্য গাদ্দাফি তাকে অর্থ দিয়েছিলেন। আর সৈয়দ ফারুক রহমান লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি কোম্পানি খুলেছিলেন। সেই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিত লিবিয়ায়।
ফ্রীডম পার্টিও পরিচালিত হতো মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির টাকায়। এ ছাড়া বংলাদেশ-লিবিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি গড়ে তোলেন সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশীদ। ঢাকায় ব্রাদার গাদ্দাফি কিন্ডারগার্টেন স্কুলও খোলা হয়েছিল। আর গাদ্দাফির লেখা গ্রিন বুক বাংলায় অনুবাদ করে জনসাধারণের মাঝে ফ্রি বিতরণের ব্যবস্থাও করেন এ দুই খুনি।
খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশীদকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনিরাও লিবিয়ায় মিলিত হতেন। লিবিয়ার ত্রিপোলি ছাড়াও বেনগাজিতে বঙ্গবন্ধুর এ দুই খুনির ব্যবসায়িক অফিস ছিল। সেখানেও অন্যান্য দেশ থেকে খুনিরা নিরাপদে মিলিত হতেন।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি আল কোরআনের আয়াত উল্লেখ করে চিঠি লিখে সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশীদকে ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে পাল্টা একটি চিঠিতে আল কোরআনের আয়াত উল্লেখ করে গাদ্দাফিকে জানিয়েছিলেন, ‘কন্যা হয়ে পিতা হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার আমার আছে। কন্যা হয়ে পিতা হত্যার বিচার না করা হবে অপরাধ।’
সূত্র জানান, ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে লিবিয়া থেকে পণ্যের আড়ালে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বাংলাদেশে আসছিল। তবে ইতালির গোয়েন্দারা বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। তাদের জলসীমা থেকে জাহাজটি তল্লাশির জন্য আটক করা হয়। অস্ত্রের সন্ধান পাওয়ার পর শুরু হয় তোলপাড়। ইতালির গোয়েন্দারা জানতে পারেন দুজন বাংলাদেশি নাগরিক ওই জাহাজটি ভাড়া করে পণ্যের নাম করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছিলেন এসব ভয়ঙ্কর অস্ত্র। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ইতালি অবহিত করে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে। ’৮৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা গুলশানের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ফারুক ও রশীদের দুই আত্মীয়কে গ্রেফতার করেন। জব্দ করেন ‘বাংলাদেশ জাতিসত্তা পরিষদ’-এর ব্যানার, অসংখ্য বিতর্কিত লিফলেট ও অসংখ্য বই। লিফলেটগুলোয় বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। তবে রহস্যজনক কারণে ওই ঘটনার তদন্ত স্থবির হয়ে পড়ে। ছেড়ে দেওয়া হয় ফারুক-রশীদের দুই আত্মীয়কে। গায়েব হয়ে যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। এর কিছুদিন পর একটি গোয়েন্দা সংস্থা অস্ত্রবোঝাই জাহাজের বিষয়ে কর্নেল ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলেও রহস্যজনক কারণে ছেড়ে দেয়। কিছু সময়ের জন্য কর্নেল ফারুক দেশত্যাগ করেন। পরে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় দেশে ফেরেন। ’৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কারণেই হয়তো ইতালিতে আটক হওয়া অস্ত্রবোঝাই জাহাজের তদন্ত চাপা পড়ে যায়। তবে এর পরও হয়তো পণ্যের নাম করে লিবিয়া থেকে অস্ত্র এসেছিল বাংলাদেশে। ফ্রীডম পার্টির নেতা-কর্মীদের হাতে শোভা পেত চকচকে নাইন এমএম পিস্তল। গ্রুপ লিডারদের তত্ত্বাবধানে ছিল চাইনিজ রাইফেল, গ্রেনেড ও এসএমজির মতো ভারী অস্ত্র।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী ও মাহবুব মমতাজী।)