মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আবাসন খাত

সিঙ্গেল ডিজিটের ঋণ, অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ সুবিধা ও রেজিস্ট্রেশন খরচ কমায় ক্রেতাদের চাহিদা বাড়ছে

রুহুল আমিন রাসেল

আবার ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে দেশের আবাসন খাত। সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতে দেওয়া প্রণোদনার ঢেউ লেগেছে ফ্ল্যাট আর জমি বিক্রিতে। জানা গেছে, এক অঙ্ক বা সিঙ্গেল ডিজিটের ঋণ সুবিধা, অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ সুবিধা ও রেজিস্ট্রেশন খরচ কমায় ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। যদিও করোনাকালে অর্থনীতি থমকে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আবাসনে। উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও আছে। কিন্তু এখনো ক্রেতাদের পুরোপুরি আস্থা আসেনি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না। তাদের আচরণ আবাসনশিল্পের সহায়ক নয় বলেও মনে করেন উদ্যোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে বাজেটে অনেক নজর দিয়েছে সরকার। এখন অনেক ক্রেতা ও উদ্যোক্তা জানতে চান- কীভাবে অপ্রদর্শিত আয় ব্যবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাজেটের সুবিধাসমূহ তুলে ধরছি। আশার কথা হলো- চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর শুরু হওয়ার পর ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ আবাসন খাতে এসেছে। ফলে চলমান করোনা মহামারীতে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে এগোচ্ছে আবাসন খাত।

রিহ্যাব সভাপতি আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আবাসন প্রকল্পে কাজের গতি কমেছে। ফলে সময় বাড়ছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আবার আবাসন খাতে ঋণ বিতরণকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাকালে অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে। এ জন্য রিহ্যাব থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন- বিএলডিএ মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আবাসন খাতে ক্রেতাদের চাহিদা তৈরি হলেও পুরোপুরি আস্থা আসেনি। ব্যাংকগুলো পরিচ্ছন্নভাবে সহযোগিতা করছে না। অনেক ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে। তাদের আচরণ আবাসনশিল্পের সহায়ক নয়।

জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরী জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্রেতাদের দিক থেকে ফ্ল্যাটের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদা তৈরি হওয়ার মূলে রয়েছে- সরকারের বেশ কিছু প্রণোদনা। এক অঙ্ক বা সিঙ্গেল ডিজিটের ঋণ সুবিধা, আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ সহজীকরণ ও ফ্ল্যাট আর জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ কমানোর ফলে ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।

তবে অ্যাডভান্স হোমস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। আবাসন খাতের অবস্থা খারাপ। এখন বিক্রি নেই বললেই চলে। তবুও প্রকল্পগুলোর টুকটাক কাজ চলছে। এর মূল কারণ, আমাদের ক্রেতা বেসরকারি খাতের। কিন্তু করোনাকালে এই ক্রেতাদের বেতন কমেছে। ফলে তারা পিছুটান দিচ্ছেন। আবার অপ্রদর্শিত অর্থ কীভাবে বিনিয়োগ হবে, সেটা নিয়েও ক্রেতাদের মাঝে এক ধরনের ভয় কাজ করছে।

এদিকে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে অধিক পরিমাণে রাজস্ব আয় ও বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল রাখতে দেওয়া আইনি নির্দেশনায় বলা হয়- দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, নতুন অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। এমন সুযোগ নিতে করদাতাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে- জমি, ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজে। এই সুবিধা নিতে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। নেই কোনো জরিমানা। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগে অর্থ পাচার ও করফাঁকি কমবে। এই পদক্ষেপে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির আশা করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সারা দেশে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিবন্ধন অধিদফতরের তথ্য বলছে- অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আবাসন খাতের স্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচা। করোনার কারণে গত ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত নিবন্ধন অধিদফতরের দালিলিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কিন্তু গত ৩১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮০টি দলিল হয়েছে। এতে সরকারের মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৫২৯ কোটি ৮১ লাখ ৫১ হাজার ৩৩৯ টাকা। প্রতি মাসে সারা দেশে স্থাবর সম্পত্তির প্রায় তিন লাখ দলিল হয়। বর্তমানে করোনাকালেও একই হারে দলিল হচ্ছে। তবে চলতি মাসে আগের চেয়ে বেড়েছে ঢাকা জেলার দলিলের সংখ্যা। গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১১ হাজার ১২১টি দলিল হয়েছে। গত মার্চ মাসে (২৫ তারিখ পর্যন্ত) ঢাকা জেলা থেকে ২২ হাজার ৬৭৪টি দলিলের সার্টিফায়েড কপি সরবরাহ করা হয়েছে। আর জুলাই মাসের ২৩ দিনে দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৯১১টি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রবাসী আয় ও অপ্রদর্শিত টাকার মালিকেরা স্থাবর সম্পত্তি বেশি কেনেন। করোনার সময়ে প্রবাসী আয় সেই তুলনায় কমেনি। পাশাপাশি এবারের বাজেটেও জমি বা ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে কেনাবেচাও আগের মতোই হচ্ছে।

তবে বিএলডিএ সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের পর থেকেই প্লট ব্যবসা পড়তির দিকে। কারোনাকালে এটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৮০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে। আর যেগুলো দলিল হচ্ছে, তার বেশির ভাগ প্লট ৮-১০ বছরের কিস্তিতে বিক্রি হওয়া। কিস্তি শেষ হলে দলিল করা হয়। তাই এখনকার প্লট বিক্রির রেখাপাত দলিলের সংখ্যায় পড়বে না। এখন যেসব সম্পত্তির দললি হচ্ছে, তার বেশির ভাগ ব্যক্তি পর্যায়ে কেনা জমির দলিল।

নিবন্ধন অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১২টি অর্থবছরে দেশে ৪ কোটি ২৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭২৯টি দলিল হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে ৪ কোটির বেশিবার স্থাবর সম্পত্তির (বিশেষ করে জমি ও ফ্ল্যাট, প্লট) হাতবদল হয়েছে। এই ১২ বছরে প্রতি মাসে গড়ে দলিল হয়েছে ২ লাখ ৯৪ হাজার ২২৭টি। ১২ অর্থবছরে দলিল থেকে সরকারের মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৯৩ হাজার ৭৪৯ কোটি ৫৬ লাখ ১২ হাজার ১০৪ টাকা। এই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে রাজস্ব আয় ছিল প্রায় ৬৫১ কোটি ৪ লাখ টাকা।

অপরদিকে করোনায় আবাসনশিল্পের পণ্যভিত্তিক ৪৫৮ উপখাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমেছে। বন্ধ ছিল প্লট ও ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ। এতে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। নেই টাকার সরবরাহ। এমন পরিস্থিতিতেও আবাসন প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যাংকগুলো কোনো সহযোগিতা না করার তথ্য দিয়েছে রিহ্যাব। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আবাসন খাতে মন্দা হলে অর্থনীতি গতিহীন হয়ে যায়।

আবাসনশিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এই খাতে জড়িত ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প খাত রয়েছে। আর ১৮ খাতে বিভক্ত পণ্যভিত্তিক উপখাত হলো ৪৫৮টি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- রড, সিমেন্ট, রেডিমিক্স, ইট, পাথরসহ ১১টি উপখাত নিয়ে সিভিল খাত। ক্যাবল, সার্কিট ব্রেকার, সুইচ-সকেট, মিটার, লাইট মিলিয়ে ৩০টি উপখাতের ইলেকট্রিক খাত। উড, দরজা, লকসহ ২৫টি উপখাত নিয়ে উড খাত। পাইপ, গ্লাস, ট্যাব, ফিটিংস, ওয়াটার পাম্প নিয়ে ২০টি উপখাতের প্লাম্বিং খাত। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রকারের টাইলস, মার্বেল, স্টোন, মোজাইক চিপস ইত্যাদি ১৩টি উপখাত নিয়ে টাইলস খাত। কমোড, বেসিন, বাথট্যাব, হ্যান্ড শোয়ার, কানেকশন পাইপ, গ্রেটিংসহ ৩৩টি উপখাত নিয়ে সেনিটারি খাত। পেইন্ট, ফোম ল্যাব, বুন্স অ্যান্ড পোলিশ নিয়ে ৬টি উপখাতের পেইন্ট খাত। শুরকি, কেমিক্যাল, এডমিক্সার, স্টোনসহ ৬টি উপখাত। ফ্লোর ব্রোম, হেয়ার ব্রুশ, সেফটি নেট, রয়েল প্লাগ, প্লামব্রুশ, হস পাইপ, প্যাড লক, মাসকিন ট্যাব ইত্যাদি ৯৭টি উপখাত নিয়ে হার্ডওয়্যার খাত। লিফট, সাব-স্টেশন, সোলার সিস্টেম, জেনারেটর, ইন্টারকমসহ ১৮টি উপখাতের ইলেকট্রিক খাত। এলুমিনিয়াম, গ্রিল, ফায়ার ডোর, স্টিল অবকাঠামো, স্কাই লাইট, এলপিজি সিস্টেম, সুইমিং পুল ইত্যাদি নিয়ে ৬৪টি উপখাতের সাব-কন্ট্রাক্ট খাত। এক্সসাভাটোর, লিঢট ট্রাক, রোড রোলার মেশিন, বুলডোজার, ডাম্প ট্রাকস, পাইপ ড্রাইভিং মেশিনসহ ১৯টি উপখাতের কনস্ট্রাকশন মেশিনারিজ খাত। সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, সেনিটারি, টাইলস, পেইন্টম সয়েল টেস্ট, পাইল ওয়ার্ক নিয়ে ২৬টি উপখাতের শ্রম খাত। এ ছাড়াও ভূমি উন্নয়ন, প্রশাসনিক, হোম এপ্লিক্যান্স ও অফিস স্টেশনারি খাতে আরও ৯০টি উপখাত জড়িত আবাসনশিল্পের সঙ্গে।

জানা গেছে, আবাসন খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাবে চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ৫৯ লাখ নির্মাণ শ্রমিকের কর্মসংস্থান। আর মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাবে আবাসন খাত স্থবির, ফলে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতে নেমেছে বিপর্যয়। আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ২১১ ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প খাত স্থবির। এসব খাতে দুই হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন হুমকিতে পড়েছে। ওই ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের মধ্যে রয়েছে- ২৭টি কনস্ট্রাকশন সামগ্রী খাত। ৪৩টি বাথ ও কিচেন ফিটিংস পণ্য সামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহকারী খাত। আরও আছে- ৪৪টি ইলেকট্রিক্যাল, ৪৪টি ফার্নিচার, ১৮টি সার্ফেচ ফার্নিশিংসহ আরও অনেক ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প।

সর্বশেষ খবর