রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাইডেনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট

ইতিহাস গড়া সর্বোচ্চ ভোট । হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়েরও রেকর্ড । রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ উচ্ছ্বাস

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

বাইডেনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট

নানা নাটকীয়তার পর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। ভোট গ্রহণের চার দিন পর গতকাল রাতে প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেলেন তিনি। পেনসেলভেনিয়া রাজ্যে জয়ের মাধ্যমে ইতিহাস গড়লেন জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অতীতে জো বাইডেনের মতো এত ভোট কেউ পাননি। শুধু তা-ই নয়, জো বাইডেনের রানিং মেট হিসেবে থাকা কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়াও আরেক ইতিহাস। যুুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কমলা হ্যারিসই প্রথম নারী, কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট। সবকিছু ঠিক থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হতে যাওয়া ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন রীতি অনুযায়ী আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন। বার্তা সংস্থা সিএনএন, বিবিসি ও রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, পেনসেলভেনিয়া রাজ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করার মাধ্যমে ২৭০ ইলেকটোরালের লক্ষ্যমাত্রা পার হন বাইডেন। পেনসেলভেনিয়ার ২০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট জিতে মোট ২৮৪ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে জয়ী হলেন তিনি। কিছু রাজ্যে এখনো ভোট গণনা চলছে। এর মধ্যে জর্জিয়া ও নেভাদায় এগিয়ে থাকা বাইডেন এ দুই রাজ্যে জিতলে ৩০৬ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন। বিপরীত দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত রাত পর্যন্ত পেয়েছেন ২১৪ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এর ফলে ১৯৯০ সালের পর ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি। এবারের নির্বাচনে যতসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন, ১৯০০ সালের পর আমেরিকার কোনো নির্বাচনে এত মানুষ ভোট দেননি। ফলে বাইডেন রেকর্ডসংখ্যক পপুলার ভোট বা সাধারণ মানুষের ভোট পেয়েছেন। বাইডেন গতকাল পর্যন্ত পপুলার ভোট পেয়েছেন ৭ কোটি ৩০ লাখের বেশি। আমেরিকায় আর কোনো প্রেসিডেন্ট এত মানুষের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হননি। বিপরীত দিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পেয়েছেন প্রায় ৭ কোটি ভোট। এটিও আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় সর্বাধিক ভোট।

বাংলাদেশ সময় গত রাতে পেনসিলভেনিয়ার ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে থাকা বাইডেন সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। জো বাইডেন এবার আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছিলেন যে ডেলাওয়ারের উইলমিংটন থেকে, সেখানেই হয় মূল বিজয় উৎসব। পরে বাইডেন এক বিবৃতিতে জয়ের প্রতিক্রিয়া জানান। জয়ের প্রতিক্রিয়ায় বাইডেন বলেন, ‘নির্বাচনী কাজ শেষ হওয়ার পর এখন সময় রাগ, ক্ষোভ, প্রতিক্রিয়া পেছনে ফেলে এক জাতি হিসেবে কাজ করার। এখন সময় আমেরিকার ঐক্যের ও বিজয়ের। বিশ্বের সেরা এ দেশটিকে নেতৃত্ব দেওয়া অবশ্যই কঠিন কাজ। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমি সব মার্কিনির জন্যই প্রেসিডেন্ট। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন আর যারা দেননি সবার জন্যই।’

পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের ফলাফলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলেও মার্কিন নির্বাচনের ভোট গণনার আনুষ্ঠানিকতা এখনো শেষ হয়নি। ভোট গণনা ও পুনর্গণনা চলতে পারে সপ্তাহজুড়েই। এর আগে দুই দফায় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা বাইডেন হোয়াইট হাউসে যাওয়ার জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছেন তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে। করোনা মহামারী ও অর্থনীতি নিয়ে শুরুতেই কাজ করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে মার্কিন সরকারি সংস্থাগুলোও। বাইডেনের নিরাপত্তা বাড়ানোর পর তার বাসভবনের নিরাপত্তার জন্য সংস্থাগুলো নো ফ্লাইং জোন ঘোষণা করেছে।

করোনা মহামারীতে নিহতদের স্মরণ করে বাইডেন বলেন, ‘গতকাল আমরা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। করোনা মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, করোনাকালে লকডাউনে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয় নিয়েও কথা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সে আলোচনায়।’ বাইডেন বলেন, ‘করোনায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সীমাহীন উদাসীনতায় আজ পর্যন্ত ২ লাখ ৪০ হাজারের মতো আমেরিকানের প্রাণ গেছে। সোয়া লাখের বেশি আমেরিকান আজও সংক্রমিত হয়েছে। ভয়ংকর একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি সবাইকে জানাতে চাই, এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের পরিকল্পনা প্রথম দিন থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছি।’

অন্যদিকে বাইডেন টিমের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলা হয়েছে। গত দুই দিনে বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণা অফিসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এ ব্যাপারে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সোমবারের মধ্যেই ‘ট্রানজিশন টিম’-এর প্রধানের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। নেতা ও উপদেষ্টারা ওয়াশিংটন ডিসিতেও মিলিত হচ্ছেন বাইডেনের মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা নিয়ে। যে উদ্যমে আমেরিকানরা ভোট দিয়েছেন, সে চেতনায় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম একটি ক্যাবিনেট গঠন করতে আগ্রহী বাইডেন নিজেও। সারা দেশের মানুষ পরিবর্তনের প্রত্যাশা নিয়ে বাইডেন-হ্যারিসকে জয়ী করেছেন। তাই তাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর সর্বাত্মক চেষ্টার পথে নিষ্ঠাবানদের ক্যাবিনেটে সমাগম ঘটানোর ইচ্ছা বাইডেন টিমের। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এ ক্যাবিনেটে থাকবেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের প্রতিনিধি।

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বললেন ট্রাম্পের উপদেষ্টা : হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ল্যারি কাডলো বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর হবে বলে তিনি মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য হিল’ ওয়েবসাইটের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের উপদেষ্টা কাডলো বলেন, ‘এটি (যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ। আমরা আইনের শাসন মেনে চলি। আর তাই প্রেসিডেন্টও তা মানবেন।’ তবে এখনো কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়া বাকি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞ নই। আমি এটি প্রচারশিবিরের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু হ্যাঁ, আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই চলব, যে রকম আমরা সব সময় করি। আর আমি এও বলব, গোটা বিশ্বে যিনিই আমাদের দেখুন, তারই এ কথা জানা উচিত।’

বাইডেনের বাড়িকে ‘নো ফ্লাইং জোন’ ঘোষণা : মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের উইলমিংটনের বাড়ি ও আশপাশের এলাকা সাময়িকভাবে ‘নো ফ্লাইং জোন’ ঘোষণা করেছে মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে বাইডেনের বাড়ির নিরাপত্তাও। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত সংখ্যক সিক্রেট সার্ভিস সদস্য। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা শুক্রবার থেকে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং সে অনুসারেই পদক্ষেপ নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় বাইডেন সমর্থকদের উচ্ছ্বাস : জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শুরু হয় সমর্থকের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। বিভিন্ন সড়কে, পার্কে, বাড়ির বারান্দায় নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন সমর্থকরা। হোয়াইট হাউসের সামনে উল্লাসে মেতে ওঠেন তারা। এ সময় তারা হোয়াইট হাউসের চারপাশে বাইডেনের প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে দেন।

বাইডেনের বিজয়ের ঘোষণা আস্রার পর ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভেনিয়া ও ওয়াশিংটনের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজার সামনে আনন্দ-উল্লাস করেন ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা। বাইডেনের নিজ শহর ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে সমর্থকরা আনন্দে রাস্তায় নেমে আসেন। দেশের পতাকা হাতে নতুন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানায় শিশু-কিশোররাও।

সর্বশেষ খবর