প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ এনে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের ৪২ নাগরিক। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ৪২ জন নাগরিকের পক্ষে ওই চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্্দীন মালিক। চিঠিতে সাংবিধানিক এই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আবেদন জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বরাবর দেওয়া আবেদনে ইসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন। কমিশনের সদস্যরা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন।
রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া আবেদনে পত্রিকায় প্রকাশিত আর্থিক অনিয়মের খবর, কর্মচারী নিয়োগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে আরেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের করা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ, নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন নির্বাচন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহার, ইভিএম কেনা ও ব্যবহারে অনিয়ম, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অসদাচরণ, অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্্দীন মালিক বলেন, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ যেহেতু পাওয়া গেছে, তাই এটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত হওয়া উচিত। এরপর সেই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে অনিয়মের কারণে অপসারণ করবেন বলে তাঁরা আশা করেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে সব সময়ই নির্বাচন কমিশন কমবেশি বিতর্কিত ছিল। কিন্তু সরাসরি আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল এমনটা দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ বিষয়গুলো দেখার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। আর সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনাররা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে দূরে থাকবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে ও সংবিধান মেনেই তাঁরা এসব অভিযোগ করেছেন। এখন নির্বাচন কমিশনের স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানো দরকার। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহ্্দীন মালিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আবেদনকারীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক পারভীন হাসান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, অধ্যাপক সি আর আবরার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। সংবাদ সম্মেলনে শাহ্্দীন মালিক বলেন, ‘আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে, সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি এ নির্দেশ দিতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগ জানিয়েছি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে তারা দোষী হবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন।’ শাহ্্দীন মালিক বলেন, সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করতে পারেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে, আগে কখনো দেখা যায়নি। আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে তারা। নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। এ বিষয়ে যত দিন সিদ্ধান্ত না হয়, তত দিন সিইসি ও কমিশনাররা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবেন।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত মহা হিসাব-নিরীক্ষক এম হাফিজউদ্দিন খান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। চিঠিতে আরও যারা স্বাক্ষর করেছেন তাঁরা হলেন- মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শাহ্্দীন মালিক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, অধ্যাপক সি আর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগসমূহ : আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণ- ১. ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম। ২. নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম। ৩. নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম। অন্যান্য গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম- ১. ইভিএম কেনা ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। ২. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। ৩. ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। ৪. খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। ৫. গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, ৬. সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
সংবাদ সম্মেলনে শাহ্্দীন মালিক বলেন, ‘দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়। রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক হিসেবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যেটা ভালো হয় করবেন। সে জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি।’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করবেন বলে যে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতেও কিছু খারাপ নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। এখন যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও এ রকম। এ ধরনের নির্বাচন কাম্য নয়। আমরা মনে করি গভীর সংকট রয়েছে। গভীর সংকটে পড়লে জাতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁর একটি নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা নিঃসন্দেহে আশাবাদী। আমরা আশাবাদী রাষ্ট্রপতি এ অভিযোগের ইতিবাচক সাড়া দেবেন।’
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিন বছর পর কেন অভিযোগ- জানতে চাইলে শাহ্্দীন মালিক বলেন, ‘আমাদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। দু-তিনটা অভিযোগ দিয়ে আমরা এটা করতে চাইনি। অপেক্ষা করেছিলাম, দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের বিষয়ে অভিযোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। গুরুতর অসদারচরণ, দুর্নীতি যথেষ্ট হয়েছে। এখানে থাকার নৈতিক অবস্থান আর (তাদের) নেই। অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে বেশ কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।’ সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো হবে।’ রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেও তা নিয়ে কিছু হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, যিনি এক সময় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কি না সন্দেহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘জানি, হয়তো আলটিমেটলি কিছু হবে না। কিন্তু তাগিদ দিলাম। সংবিধানে আছে।’ বিষয়টি ‘ফলোআপ’ করতে সাংবাদিকদের অনুরোধ জানান তিনি।