মঙ্গলবার, ১৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বর্ণযুগে প্রবেশ বাংলাদেশের

দেশেই পরিশোধন হবে সোনা হীরা মূল্যবান ধাতু, বিদেশে রপ্তানি হবে কয়েন বার অলঙ্কার, কমবে চোরাচালান

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

স্বর্ণযুগে প্রবেশ বাংলাদেশের

স্বর্ণযুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এখন থেকে অপরিশোধিত বা আকরিক স্বর্ণ এনে দেশেই পরিশোধন করে সেটি রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এ জন্য স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনের সুযোগ পাবেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। শুধু স্বর্ণ নয়, হীরা, রৌপ্যসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর আকরিক বাংলাদেশে আমদানি করে সেটি পরিশোধনের সুযোগ দিয়েছে সরকার।

গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ (সংশোধিত, ২০২১) খসড়াটি অনুমোদনের ফলে বাংলাদেশের শিল্প খাত স্বর্ণযুগে প্রবেশের এই সুযোগ পেয়েছে। সংশোধনী নীতিমালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুধু স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনের প্রস্তাব ছিল। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বর্ণের সঙ্গে হীরাসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুও পরিশোধনের সুযোগ রাখার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সচিবালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সংশোধিত নীতিমালায় স্বর্ণ শোধনাগারের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোনটি স্বর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে, কোথায় পরীক্ষা করা যাবে- এসব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ নীতিমালার আওতায় সোনার বার ও স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি অপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিক এবং আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণ আমদানি করা যাবে। পরে তা দেশে পরিশোধন করে বিভিন্ন গ্রেডের সোনার বার তৈরি করার সুযোগ হবে। স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপন ও পরিচালনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি মান ঠিক করে দেবে। যারা সোনার বার রপ্তানি করতে চান, তাদের অবশ্যই স্বর্ণ পরিশোধনাগার থাকতে হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি জানান, নিজস্ব ব্যবসার জন্য স্বর্ণবার আমদানির ক্ষেত্রে জামানত প্রয়োজন হবে না। এ বিষয়ে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে নীতিমালায়। সূত্র জানায়, স্বর্ণালঙ্কার উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় দেশ এবং ভারত ও চীন অন্যতম। আর প্রধান আমদানিকারক দেশ হিসেবে আছে সুইজারল্যান্ড, চীন, যুক্তরাজ্য, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, জার্মানি ও সিঙ্গাপুর। এসব দেশের সঙ্গে এখন থেকে বাংলাদেশের নাম সংযুক্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে হাতে নির্মিত স্বর্ণালঙ্কারের ৮০ শতাংশ ভারত ও বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। নানা কারণে বাংলাদেশ এ খাতে রপ্তানিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ খাত থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৭০০ থেকে ৮০০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। অথচ পাশর্^বর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বর্ণের তৈরি অলঙ্কার সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকায় এটি একটি রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাত। এ ছাড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা স্বর্ণের বার আমদানি করে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করেন। সংশোধিত স্বর্ণ নীতিমালায় পরিশোধনাগার স্থাপনের সুযোগ দেওয়ার ফলে দেশে সম্ভাবনাময় স্বর্ণ শিল্প গড়ে উঠবে। ফলে বাংলাদেশ এখন আর আমদানিকারক নয়, স্বর্ণ, হীরাসহ মূল্যবান ধাতুর অলঙ্কার রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করল বলে মন্তব্য করেন এই সিনিয়র সচিব।

বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আইন-১৯৪৭ অনুযায়ী শর্ত পালন করে সোনা ও রুপা আমদানি করা যায়। তবে আমদানির আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। নানা শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরা এ প্রক্রিয়ায় সোনা আমদানি করতে পারেন না। দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন সোনা লাগে। যার বড় অংশ বিদেশফেরত বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে, কিছুটা আমদানি করে ও পুরনো সোনা গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সোনা ব্যবসায়ীরা তাদের মজুদ সোনার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। ড. জাফর উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সংশোধিত নীতিমালায় একটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে, যারা পরিশোধনাগার স্থাপন করবে শুধুমাত্র তারাই স্বর্ণের বার, কয়েন, মূল্যবান ধাতুর অলঙ্কার রপ্তানির সুযোগ পাবেন। দেশে পরিশোধনাগার স্থাপনের ফলে এখন আর কেউ পরিশোধিত স্বর্ণের বার বা কয়েন আমদানি করবে না। বরং দেশীয় উদ্যোক্তারা কয়েন ও বার তৈরি করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে। এটি শ্রমঘন খাত হওয়ায় কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

যা আছে সংশোধিত নীতিমালায় : নতুনভাবে সরকার, স্বর্ণ ও পরিশোধনাগারের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; নীতিমালাটি সংশোধনের ফলে স্বর্ণবার ও স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি অপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিক/আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণ আমদানি করা সম্ভব হবে; অপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিক/আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণ থেকে বিভিন্ন গ্রেডের স্বর্ণবার ও স্বর্ণ কয়েন উৎপাদনে পরিশোধনাগার স্থাপনের পথ সুগম হবে; স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপন ও পরিচালনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মানসম্মত পরিচালনা পদ্ধতি প্রণয়ন করবে।

এ ছাড়া, স্বর্ণমান ও বিশুদ্ধতা সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএসটিআই অথবা বিএসটিআই কর্তৃক স্বীকৃত অ্যাক্রেডিটেড সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; স্বর্ণবার রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের অবশ্যই স্বর্ণ পরিশোধনাগার থাকতে হবে মর্মে নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। সংশোধিত নীতিমালায় অনুমোদিত ডিলার চালানভিত্তিক সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনাপত্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ১৫ কার্যদিবসের পরিবর্তে ১০ কার্যদিবস করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর