বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

দারিদ্র্য দেখতে জরিপের প্রয়োজন নেই

মানিক মুনতাসির

দারিদ্র্য দেখতে জরিপের প্রয়োজন নেই

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মহামারী করোনায় নতুন করে বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্র হয়েছে। তবে সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। আড়াই কোটি না হোক দেড় কোটি তো হবে, না হয় ১ কোটি হবে। করোনা মানুষকে দরিদ্র করেছে, এটা তো সঠিক। আর এটা দেখার জন্য জরিপের প্রয়োজন হয় না। খালি চোখেই দেখা যায়।

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রামে হোক কিংবা শহরে নিজের আশপাশে তাকালেও বোঝা যায় মানুষ কষ্টে আছে। তবে হ্যাঁ দারিদ্র্যের প্রকোপটা কেমন অর্থাৎ এর মাত্রাটা কি? অতি দরিদ্র নাকি দরিদ্র, তা বোঝার জন্য জরিপের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছিল তা ঠিকই ছিল। কিন্তু এর বাস্তবায়ন সঠিক হয়নি। কেননা এগুলো ছিল ঋণনির্ভর, ব্যাংকনির্ভর। আর ব্যাংকগুলো তাদেরই ঋণ বেশি দিয়েছে যারা ধনী ও বণিক বলে মনে করে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী অর্থাৎ ফুটপাথের ব্যবসায়ী বা ছোট ছোট উদ্যোক্তা, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, যাদের ব্যাংকের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, তারা কিন্তু এসব প্যাকেজের কোনো উপকারিতা পায়নি। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে একেবারে ঝরে পড়েছে। তারা ব্যবসাই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের এখন নগদ সহায়তা দেওয়া উচিত। এখানে প্রণোদনা প্যাকেজটাকে আরও বড় করা যেতে পারে। এ ছাড়া আমাদের শিল্প, বাণিজ্য, সেবা খাতের সঙ্গে জড়িতরাও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু কৃষি খাতই কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে। তবে পুনরুদ্ধারের গতি মন্থর। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া রপ্তানি খাতটাও মোটামুটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রেমিট্যান্সও বেশ উচ্চ হারে আসছে। বৃহৎ শিল্প খাতগুলোও উৎপাদনে ফিরেছে। তবে অর্থনীতির এই সূচকগুলো কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মানের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে না। কারণ বাস্তবতা ভিন্ন। তবে আমরা অন্য ক্ষেত্রে ভালো করছি। আবার অন্য যেসব ছোট ছোট দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো খোলেনি। পর্যটন খাত এখনো অচল। পরিবহন খাতেও এখনো বেহাল অবস্থা। তিনি বলেন, এখানে বলতে হয়, অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো করেছি। তবে ভিয়েতনাম, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশ ইকোনমি রিকোভারিতে বেশ ভালো করেছে। আমরা ততটা ভালো করতে পারিনি। এখানে এই মুহূর্তে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মনোযোগী হতে হবে। এ মুহূর্তে মানুষ বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চায় না। বিনিয়োগ করলে পুঁজির নিশ্চয়তা কী হবে, রিটার্ন কী আসবে সেসব নিয়ে ভাবছেন উদ্যোক্তারা। ফলে এখন সরকারের উচিত হবে যারা কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন, তাদের জন্য কিছু করা। তাদের কর্মমুখী কোনো সুবিধা দেওয়া। একই সঙ্গে যারা শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছেন তাদের গ্রামে পুনর্বাসিত করা। এর সংখ্যাও কম নয়। আবার সরকারের সক্ষমতারও ব্যাপার রয়েছে। তারপরও এখানে সরকার চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। ধরা যাক, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যে সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল তার বাস্তবায়ন তো অর্ধেকও হয়নি। তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করলেও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে যাবে। এতে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘব হবে।

আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার নতুন বাজেট ঘোষণা করেছে। সেখানে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। করোনা বাস্তবতায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করাটা কতটা সম্ভব হবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, এটা হবে না, তবে কাছাকাছি হবে। এটা যদি ৬ বা সাড়ে ৬ শতাংশও হয়, তাও বেশ ভালো হবে। অনেক দেশ তো তাও অর্জন করতে পারবে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ খাতগুলো বেশ ভালো আছে। ফলে আমরা হয়তো এটার কাছাকাছি অর্জন করতে পারব। তবে বিশ্বব্যাংক যেটা বলেছে, সেটা তারা অনেক কম বলেছে। অবশ্য বিশ্বব্যাংক এমন কনজারভেটিভ ওয়েতে সব সময়ই প্রক্ষেপণ করে থাকে। এবারই প্রথম সরকার বাজেট ঘাটতিকে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এটা আমাদের অর্থনীতি এবং বাজেট বাস্তবায়নে কী রকম প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন। জবাবে তিনি বলেন, এটা আমাদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা না। আমি মনে করি এ মুহূর্তে আমাদের বাজেট ঘাটতি যদি ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যায় সেটাও তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। আমাদের ব্যয় করার সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে ৬ শতাংশ বাজেট ঘাটতি অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা অংশ বন্দরে বিনিয়োগ করছি। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। যেহেতু আমাদের এক্সেস রিজার্ভ রয়েছে, তাহলে সেটা বসিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। ফলে আমরা এটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আমাদেরই লাভ। এ ছাড়া সোয়াপের অধীনে আমরা শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছি রিজার্ভ থেকে। এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত। ভারত তো তাদের রিজার্ভের ২ বিলিয়ন ডলার সোয়াপের অধীনে বিনিয়োগ করে থাকে। তবে এটার ক্ষেত্রে আমাদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যা আমি আগেও বলেছি। দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে তিনি বলেন, এখানে সবার আগে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ঋণ অনুমোদনের আগে অধিক যাচাই-বাছাই করতে হবে। এখানে সেন্ট্রাল ব্যাংকের দায়িত্বটা অনেক বড়। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, ব্যাংক খাতকে ইগনোর করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে আমাদের আর্থিক খাতে আরও বেশি ঝুঁকি বাড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর