শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
কারাবন্দী দিবসের আলোচনা সভায় বক্তারা

দলের বড় বড় অনেক নেতা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের ইন্ধন জুগিয়েছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

দলের বড় বড় অনেক নেতা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের ইন্ধন জুগিয়েছিলেন- এই অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। শেখ হাসিনার কারাবন্দী দিবস উপলক্ষে গতকাল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা আরও অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে নিজেদের বিকল্প ভাবতে শুরু করেছিলেন। নেতারা এখন বড় বড় পদধারী, মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন। শেখ হাসিনা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। সবাইকে নিয়েই তিনি চলেছেন। তারা বলেন, ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যেন আরেকটি ১৫ আগস্ট না ঘটে। সকাল সাড়ে ১০টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর সভাপতিত্বে এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ওবায়দুল কাদের বলেন, এখনো অনেকে আরও একটা এক-এগারোর রঙিন স্বপ্নে বিভোর। তবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যারা এসব খোয়াব দেখছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের সে স্বপ্ন সফল হতে দেবে না।  আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলের ভিতর ও বাইরের ষড়যন্ত্রকারী, দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রকারীরা তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসবেন সেটা চায়নি। তারা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিতে সব আয়োজন করে ফেলেছিল। এমন সময় সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা কিংস পার্টি তৈরি করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টাও করেছে। আমাদের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ বানিয়ে মনোবল ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে থাকে। তখন স্বেচ্ছাসেবক লীগ-যুবলীগের মতো ফ্রন্টলাইন শক্তিকে দমিয়ে রাখতে অগণতান্ত্রিক সে সরকার অপতৎপরতা চালায়। তারা ভেবেছিল যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগকে দমিয়ে রাখা গেলেই শেখ হাসিনাকে দুর্বল করে দেওয়া যাবে।  যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান নানক বলেন, ১/১১ সরকারের সময়ে আমাদের নেত্রী জানান ‘তোমরা (মির্জা আজম ও নানক) আত্মগোপনে চলে যাও, প্রয়োজনে একশো হাত মাটির নিচে চলে যাও, তোমাদের ক্রসফায়ার দেবে’। তিনি বলেন, নেত্রীকে যেদিন গ্রেফতার করা হয়, সেদিন ভোরে নেত্রী আমাকে ফোন করে বললেন, নানক-আজম আমি চলে যাচ্ছি। একটা চিঠি লিখে যাচ্ছি এটা দেশবাসীর উদ্দেশে প্রচার করবে। নানক-এটাই হয়তো তোমাদের সঙ্গে শেষ কথা। আমাকে কী করবে তাও জানি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা কী পরিমাণ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, আমাকে গ্রেফতারের পর দেখো। সেদিন আমরা অনেক নেতার মুখোশ দেখেছিলাম। সাবেক প্রতিমন্ত্রী নানক বলেন, আজকের বাংলাদেশে কাক ও কোকিল চেনা বড় দুষ্কর। আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না কে আপন কে পর। সাদা আর কালো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই সামনে যত ষড়যন্ত্রই থাক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে নেত্রীর নেতৃত্বে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।  আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়াম লীগের শ্রদ্ধেয় অনেক নেতা, যাদের আমরা পীরের মতো শ্রদ্ধা করতাম, বাবার আসনে বসিয়েছিলাম তারাও ষড়যন্ত্র করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করেছেন গোপনে। তিনি বলেন, তারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছেন। শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবতে শুরু করেছিলেন। তারা নিজেদের জাতীয় নেতা দাবি করেন। তিনি বলেন, দুর্দিনে সুবিধা খোঁজা এসব নেতাকে চিনতে হবে, জানতে হবে।  নাছিম বলেন, অনেকেই সেদিন আমাদের বলেছিলেন, নেত্রীর পরে কাকে দেওয়া যায়? শেখ হাসিনার কথা ভুলে যাও। হাজারো প্রমাণ আছে। তিনি বলেন, এখনো ষড়যন্ত্র থেমে নেই। একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা জীবনে ছাত্রলীগ করেনি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক পরিচয় পাওয়ার জন্য এখন বলছে বাকশাল করেছেন। তারা ইতিহাস বিকৃত করার পাঁয়তারা করছেন। তিনি বলেন, এই আওয়ামী লীগ অফিসে তালা দিতে এসেছিল, সেসব সুবিধাবাদীর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, আমরাই বিএনপি-জামায়াত সরকারের নির্যাতনের এক পর্যায়ে চেয়েছিলাম সেনা সরকার ক্ষমতায় আসুক কিছুদিনের জন্য। সেনাসমর্থিত সরকার আসার পর আমরা আনন্দ মিছিলও করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তাদের ভিন্ন রূপ। তারা বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের হয়রানি শুরু করে। সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে (আমেরিকায়) যান, তখন তাঁকে বলেছিলাম আপনার ফেরায় বাধা আসতে পারে। তখন তিনি বলেছেন, আকাশপথে যদি না আসতে দেয় পায়ে হেঁটে হলেও দেশে আসব। প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ঘুমন্ত শহরে ভোরে শেখ হাসিনাকে আটক করে আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে দলের আইনজীবীরা থাকলেও নেত্রী নিজেই আদালতে যুক্তি তুলে ধরছিলেন। সেদিন সারা শহরের নেতা-কর্মীরা আদালতে হাজির হন। কোর্ট এক রকম ঘেরাও করে রাখেন। তিনি বলেন, নেত্রীকে গ্রেফতারের পর জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা ছিল সবচেয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। জিলুøুর রহমানের কারণে অনেকে খেলাধুলা করার সুযোগ পায়নি। আওয়ামী লীগ কর্মীনির্ভর দল বলেই শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে পারেনি : এদিকে দুপুরে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতানির্ভর দল নয়, কর্মীনির্ভর দল। নেতারা বিভ্রান্ত হলেও কর্মীরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণে ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে পারেনি। তৃণমূলে কর্মীরাই সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কার্যকরী সভাপতি রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম এমপি। সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজন হালদারের সঞ্চালনায় অংশ নেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, আওয়ামী লীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারিন জাহান, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির সদস্য সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রনি প্রমুখ।

শ ম রেজাউল করিম বলেন, এখনো কিন্তু শেখ হাসিনা নিরাপদ নন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার অনেক শক্তি কিন্তু চান শেখ হাসিনা না থাকলে ভালো হয়। অনেক অপশক্তিও এটাই চায়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার যে সূচনা হয়েছিল, আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা বিকশিত হয়েছে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে কফিনবন্দী করে দীর্ঘস্থায়ী সেনা শাসন বলবৎ করার জন্যই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিথ্যা ও সাজানো মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করেছিল। বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে দেশে ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রথমে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করেছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে পারলে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে আনা যাবে। তিনি বলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এ সময় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করার দাবি জানান।

সর্বশেষ খবর