মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকামুখী এখনো অনেক মানুষ

♦ সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক ♦ বিধিনিষেধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আজ ♦ লঞ্চ চলাচল বন্ধ, ফেরিতে পার হচ্ছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকামুখী এখনো অনেক মানুষ

সড়কে বাড়ছে গাড়ির চাপ। গতকাল তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই গার্মেন্টসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্প ও কলকারখানা চালু হওয়ায় কর্মীদের আসার সুবিধার্থে এক দিনের জন্য গণপরিবহন চালু করা হয়েছিল। গণপরিবহন বন্ধ হলেও এখনো ঢাকায় ফিরছে অনেক মানুষ। মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে সকালে যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। গতকাল সকাল থেকে ছয় ঘণ্টা লঞ্চ চলাচল করার পর দুপুর ১২টায় এ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়। পরে ফেরিগুলোতে করে যাত্রীরা পার হন। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ফেরিঘাটে গতকাল ঢাকামুখী মানুষ ও যানবাহনের ভিড় ছিল। এ ছাড়া রাজধানীতে বিভিন্নভাবে প্রবেশ করছে অসংখ্য মানুষ। ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে ছিল পণ্যবাহী পরিবহনের পাশাপাশি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের চাপ।

কঠোর লকডাউনের একাদশ দিনে গতকাল রাজধানীতে বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল হয়ে পড়ে। মানুষের চলাচল আগের তুলনায় বেশি ছিল। সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক দেখা গেছে। যানজটেও পড়েছেন নগরবাসী। অলিগলিতে প্রায় সব ধরনের দোকানই খুলেছে। ফলে মানুষের আনা গোনাও বেড়েছে।

এদিকে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণে আজ আবারও বৈঠকে বসছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা। আজ বেলা ১১টায় অনলাইনে আন্তমন্ত্রণালয় এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ১৬ জন সচিব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, আইইডিসিআর পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেবেন। ইতিমধ্যে সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, ওই সভায় বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুপারিশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ আলাপ আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণের বিষয় চূড়ান্ত করে তা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হবে।

সূত্র জানিয়েছে, বৈঠক থেকে কিছু শর্ত শিথিল করে আরেক দফা বিধিনিষেধ বাড়ানো হতে পারে। এর মেয়াদ হতে পারে আরও সাত দিন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর আরও সাত দিনের জন্য লকডাউনের মেয়াদ বাড়লে সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অফিস সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হতে পারে। সীমিত পরিসরে চালু করা হতে পারে গণপরিবহন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান লকডাউন আরও ১০ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এখনো ঢাকায় ফিরছে মানুষ : ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে রাজধানীমুখী গাড়িগুলো থামিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ। সকালে রাজধানীর গাবতলীর চেকপোস্টে দেখা গেছে, রাজধানীতে আসা বেশির ভাগই কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে পোশাক কারখানা এবং চিকিৎসাকে। পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহন চালুর কথা শুনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে সবকিছু গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই এক দিন পার হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে এখন বিকল্প ব্যবস্থায় এসেছেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং পরিচয়পত্র দেখানো সাপেক্ষে রাজধানীতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে পুলিশ। আর যারা যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারছেন না তাদের জরিমানাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

গতকাল রাজধানীর সড়কগুলোতে কর্মজীবী মানুষের উপস্থিতি বেশি ছিল। সকালে রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে কর্মস্থলে যোগ দিতে বিপুল পরিমাণ কর্মজীবী মানুষ বাসা থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু কোনো গণপরিবহন না পাওয়ায় তাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এই সুযোগে রিকশার ভাড়াও বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ। অনেকেই কিছুটা সাশ্রয়ী বাহন ভ্যানগাড়ি যোগে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা করছেন। এক একটি ভ্যানে ছয় থেকে আটজনকে পাশাপাশি বসতে দেখা গেছে। আবার কর্মজীবীদের অনেকেই হেঁটেই যাচ্ছেন কর্মস্থলে।

লকডাউনের একাদশ দিনে ঢিলেঢালা ভাব : করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনের একাদশ দিনে গতকাল রাজধানীতে বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। মানুষের চলাচল আগের তুলনায় বেড়েছে। যানবাহন বাড়ায় কোনো কোনো সড়কে যানজটেও পড়েছেন নগরবাসী। অলিগলিতে প্রায় সব ধরনেরর দোকানই খুলেছে। ফলে মানুষের আনা গোনাও বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা গেছে। রাজধানীর রামপুরা, কাকরাইল, আজিমপুর, নিউমার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এলাকায় মানুষের ব্যস্ততা আগের চেয়ে বেশি দেখা গেছে। মালিবাগ, শান্তিনগর, বিজয়নগর, ফকিরাপুল এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বেড়েছে। একজন বেসরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় সোমবার (গতকাল) রাস্তায় প্রাইভেট কার বেড়েছে। মতিঝিলের অনেক অফিসে কাজকর্ম শুরু হয়েছে। সে জন্য এত প্রাইভেট কার। রাস্তায় যানবাহন বাড়ার পাশাপাশি ফুটপাথেও মানুষের চলাচল বেশি দেখা গেছে। ব্যাংক, কর্মস্থল ও বাজারে যাওয়ার কথা বলছেন পথচারীরা। রবিবার কারখানা খোলার পর রাস্তায় যানবাহন ও মানুষের চলাচলে যে শিথিলতা ছিল, গতকালও একই চিত্র দেখা গেল মিরপুরে। দু-চারটি অটোরিকশাও চলতে দেখা গেছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া লোকজন বিধিনিষেধ ভেঙে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে সকালের নাস্তাও খেতে পেরেছেন। সকাল ১০টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় দেখা গেল, রিকশা, মিনিবাস, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চলছে। মানুষের উপস্থিতি ও চলাচলও আগের তুলনায় বেড়েছে। কালশী সড়কেও ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল ছিল আগের চেয়ে বেশি। কালশী মোড়ে মোটরসাইকেলের পাশাপাশি ভাড়ায় যাত্রী নিতে দেখা গেছে প্রাইভেট কার চালকদের। মিরপুরের রূপনগর, পল্লবী, আরামবাগ এলাকায় প্রায় সব ধরনের দোকানপাট খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। নিত্যপণ্যের দোকান ও হোটেল রেস্তোরাঁ ছাড়া অন্যান্য দোকানের শাটারের এক অংশ খোলা রেখে বেচাকেনা চলছে।

রাজধানীতে গ্রেফতার ৩৪৫ : কঠোর বিধিনিষেধের ১১তম দিনে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অকারণে বাইরে বের হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন আরও ৩৪৫ জন। এ সময় ১৩৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাফিক বিভাগ ৩৬৬টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে জরিমানা করেছে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম ১০ দিনে রাজধানীতে মোট গ্রেফতার হয়েছেন ৪ হাজার ৬৫৩ জন। বিধিনিষেধ নিশ্চিতে করতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১১তম দিনেও রাজধানীজুড়ে সক্রিয় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সড়কে যানবাহনের চাপ : আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের তথ্যানুযায়ী গতকাল মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। সকাল থেকে ছয় ঘণ্টা লঞ্চ চলাচল করার পর দুপুর ১২টায় এ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়। দুপুর ২টার দিকে বাংলাবাজার ঘাট ও শিমুলিয়া ঘাটে পারের অপেক্ষায় কোনো যানবাহন দেখা যায়নি। সকালের দিকে ঘাটে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও লঞ্চ বন্ধের পর ফেরি দিয়ে যাত্রীরা পার হন। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার, শরীয়তপুর মাঝিকান্দি নৌপথে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৬০টি লঞ্চ চলাচল করেছে। এ সময় ঢাকামুখী যাত্রীদের ভিড় ছিল। শিমুলিয়া লঞ্চঘাটে যাত্রীদের স্বাভাবিক উপস্থিতি ছিল। লঞ্চ বন্ধের পর ফেরিতে করেই ঘাটে আসা যাত্রীরা পদ্মা পার হয়েছেন। সকালের লঞ্চগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে যাত্রীদের গাদাগাদি করে নদী পার হতে দেখা যায়। কয়েকটি ফেরিতে শতাধিক মানুষের ভিড় ছিল। তবে শিমুলিয়া ঘাটে আসার পর পরিবহন সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অতিরিক্ত ভাড়া গুনে সিএনজি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও পিকআপে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তারা। গতকাল সকাল থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে ১৭টি ফেরির মধ্যে ৯টি ফেরি চলাচল করেছে। শিমুলিয়া ঘাট থেকে স্বাভাবিকভাবেই যানবাহন পদ্মা পার হতে পেরেছে। তবে বাংলাবাজার ঘাট দিয়ে তুলনামূলক বেশি ঢাকামুখী যানবাহন পার হয়েছে। গতকাল বেলা ১২টায় লঞ্চ বন্ধের পরও ফেরিগুলোতে যাত্রীদের স্বাভাবিক উপস্থিতি ছিল। বাংলাবাজার ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য বলেন, গতকাল বেলা ১২টায় লঞ্চ বন্ধের পর যাত্রীদের উপস্থিতি বেড়েছে। সকালে যানবাহনের চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি কমে গেছে। সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজারের বেশি যানবাহন বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে পদ্মা পার হয়েছে। সকাল ৮টায় ৩৫০টি যানবাহন পারের অপেক্ষায় ছিল।

পাটুরিয়া-আরিচা ঘাটে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় : মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ফেরিঘাটে গতকাল ঢাকামুখী মানুষ ও যানবাহনের ভিড় ছিল। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ফেরিতে পদ্মা ও যমুনা পাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাটে আসেন দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কর্মস্থলমুখী মানুষ। দেখা গেছে, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পদ্মা পারি দিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে আসার পর মানুষ খোলা ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন। একইভাবে পাবনার কাজিরহাট থেকে ফেরিতে যমুনা পারি দিয়ে আরিচা ঘাটে এসে নানা উপায়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন মানুষ। সে সময় পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ঘাটে ও মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জরুরি পণ্যবাহী পরিবহন, রোগী ও লাশবাহী গাড়ি পার করার জন্য পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ১৬টির মধ্যে ১৪টি ফেরি চালু রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে চালু রয়েছে তিনটি ফেরি। যাত্রী ও ব্যক্তিগত গাড়ির কিছুটা চাপ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ কারণে ফেরিতে জরুরি পণ্যবাহী পরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি ও যাত্রীরা জোর করেই ওঠে পড়ছেন।

সর্বশেষ খবর