সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
বরিশালে সুবাতাস

শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মেয়রের বৈঠকে সমঝোতা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বরিশাল

বরিশালের বিবদমান সমস্যা সমাধানে গত রাতে বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিটি মেয়রসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং পুলিশ ও ইউএনওর দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ, বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল, পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান, ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান, র‌্যাব সিইও মো. জামিল হোসেন, জেলা প্রশাসক জসীমউদ্দিন হায়দার, পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস, প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটুসহ ১১ জন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ কে এম জাহাঙ্গীর জানান, বরিশালে চলমান সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নির্দেশে বিভাগীয় কমিশনারের আহ্বানে রাতে তার সরকারি বাসভবনে চা-চক্রের আমন্ত্রণ ছিল  মেয়রসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। সেখানে যাওয়ার পর নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়। এ সময় সেখানে চলমান সমস্যার বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় এবং পুলিশ ও ইউএনওর করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে ইউএনওসহ অন্যদের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার বিষয়েও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়। এ সমঝোতা ও সিদ্ধান্তে উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট এবং প্রধানমন্ত্রীও খুশি হবেন বলে জানান মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসকের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

ইউএনও ওসির বিরুদ্ধে মামলা : এর আগে গতকাল অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান ও কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা হয়। মামলাটি তদন্ত করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেয় আদালত। এর আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সিটি মেয়রকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছিল। এ ঘটনাকে ‘একটি স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন বিষয়’ উল্লেখ করে রবিবার সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, মামলা যে কারও বিরুদ্ধে হতে পারে। ইতিপূর্বে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলা হলে সেটি তদন্তে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত কিছু বলা সমীচীন নয়। অভিযোগ দায়ের হতে পারে, তা সঠিক কি না সেটি তদন্তের পর বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, বরিশালে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিটি করপোরেশন ও প্রশাসনের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তা খুব শিগগিরই সমাধান হবে। আর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, সবাইকে এখতিয়ারের মধ্যে থেকে আচরণ করতে হবে। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। সমস্যা সমাধানে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সরকার সবকিছু দেখছে।

বরিশালের ঘটনাকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক সচিব ও ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন খান। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বরিশালের ঘটনায় সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। প্রথমে রাজনৈতিক দল ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলা করায় বেশি বাড়াবাড়ি করলেও ইউএনও কিন্তু কোনো ছাড় দেননি। তিনিও গুলির নির্দেশ দিয়েছেন, যা ওই মুহূর্তে দরকার ছিল। তবে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বাসা) বিবৃতির ভাষা বেশি শক্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ সরকার ও প্রশাসন দুটি আলাদা করা খুব কঠিন। এ কারণে বিবৃতির ভাষা আরও শালীন হতে পারত। আর মামলা দিয়ে কোনো সুফল আসবে না; বরং তিক্ততা আরও বাড়বে। সরকারি দল ও প্রশাসন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে। প্রশাসন সবসময় সরকারের অনুগত থাকবে- এটিই স্বাভাবিক।’

এদিকে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. নুরুল ইসলাম এবং পাঁচ আনসার সদস্যসহ ১১৪ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি নালিশি মামলা হয়েছে আদালতে। শুনানি শেষে আদালত মামলা দুটি গ্রহণ করে অভিযোগ তদন্তের জন্য পিবিআই পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে গত বুধবারের ঘটনায় পুলিশ এবং ইউএনওর দায়ের করা দুই মামলায় গ্রেফতার আওয়ামী লীগের ১৮ নেতা-কর্মীর জামিন নামঞ্জুর করে তাদের সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সদর ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. নুরুল ইসলাম, কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক শাহজালাল মল্লিক এবং ইউএনওর বাসায় দায়িত্বরত পাঁচ আনসার সদস্যের পদ উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি নালিশি আবেদন দায়ের করেন গত বুধবার রাতে উপজেলা পরিষদে গুলিবিদ্ধ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।

অপরদিকে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার বাদী হয়ে সদর ইউএনও ও তার বাসার নিরাপত্তায় দায়িত্বরত পাঁচ আনসার সদস্যের পদ উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে একই আদালতে আরেকটি নালিশি আবেদন করেন। আদালতের বিচারক মো. মাসুম বিল্লাহ শুনানি শেষে বিকাল সাড়ে ৪টায় আদেশ দেন। আদালত নালিশি মামলা গ্রহণ করে অভিযোগ তদন্ত করে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর ধার্য তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পিবিআই বরিশালের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির মো. কামরুল হাসান। আদালতের আদেশ পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন একটি মামলার বাদী জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।

দুটি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মেয়র সাদিক আবদুল্লাহসহ অন্যদের গুলি করে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী তালুকদার মো. ইউনুস এবং দিলীপ ঘোষ। এ মামলায় আসামিরা দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজার বিধান রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। দুটি মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবীরা ন্যায়বিচারের আশা করেন। কোতোয়ালি মডেল থানা এ সংক্রান্ত মামলা গ্রহণ না করায় আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করার কথা বলেন আইনজীবীরা। এদিকে গত বুধবারের ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় দায়ের হওয়া দুই মামলায় গ্রেফতার ২১ জনের মধ্যে ১৮ জনের জামিনের জন্য গতকাল অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা। আদালত শুনানি শেষে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে এবং একই সঙ্গে বিচারক মো. মাসুম বিল্লাহ কারাভ্যন্তরে আসামিদের সুচিকিৎসার নির্দেশ দেন বলে জানান গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের আইনজীবী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মাসউদ বাবলু।

পোস্টার-ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে গত বুধবার রাতে সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে আনসার সদস্যদের তিন দফা গুলি এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়। এ ঘটনায় পরদিন ১৯ আগস্ট কোতোয়ালি মডেল থানায় উপপরিদর্শক শাহজালাল মল্লিক বাদী হয়ে একটি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে প্রধানসহ দুটি মামলায় মোট ৬০২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় সব শেষ গত শনিবার রাতে নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস মুন্সীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ নিয়ে ওই দুই মামলায় বরিশালে ২২ জন গ্রেফতার হয়েছে। অপরদিকে দুই মামলার আরেক আসামি নগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইয়েদ আহমেদ মান্নাকে গত শুক্রবার রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাকে এখনো বরিশাল নেওয়া হয়নি।

সর্বশেষ খবর