দেড় বছরের শিশু মিম নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বাবা রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, ‘১০ সেপ্টেম্বর জ্বর আসে মেয়ের। দুই দিন পর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানকার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন নিউমোনিয়া হয়েছে। এখন অবস্থা ভালোর দিকে। আমার ভাইয়ের ছেলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমরা খুব বিপদে আছি।’
ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে কখনো ঠান্ডা কখনো গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বড়রাও ভুগছেন সর্দি-জ্বরে। কিন্তু শিশুদের জ্বর অনেক সময় নিউমোনিয়ায় রূপ নিচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি। ঢাকা শিশু হাসপাতালসূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১১ জন। নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে তিনজন। প্রতিদিন নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংকটাপন্ন রোগী ভর্তি হচ্ছে এ হাসপাতালে। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সময় শিশুরা ভাইরাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়া শিশুদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। গরমের মধ্যে বাইরে ঘোরাঘুরি করলে শিশুরা বেশি ঘামছে। ঘাম বসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করায় মানুষ বেশি বাইরে যাচ্ছে। হাসপাতালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ভর্তি শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বড়রাও আক্রান্ত হচ্ছেন ভাইরাল জ্বর, ঠান্ডায়। কিন্তু শিশুদের জটিলতা বেশি হয়।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিওনেটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ডা. সঞ্জয় কুমার দে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতি বছর এ সময় শিশু নিউমোনিয়া রোগী বাড়ে। যেহেতু আগে থেকে মৌসুম জানা থাকে তাই অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে। শিশুদের গরম-ঠান্ডা সহনীয় পরিবেশে রাখতে হবে। তার পরও যদি জ্বর, সর্দি, ঠান্ডা, কাশিতে আক্রান্ত হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এখন যেহেতু করোনার সময়, আবার ডেঙ্গুও হচ্ছে তাই জ্বর এলে করোনা ও ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। উপসর্গ শুরু হতেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনেকে অবহেলা করে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তখন হাসপাতালে নিয়ে যান। এই সময়ে শিশুদের দিকে বাড়তি খেয়াল দিতে হবে।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শুধু ঠান্ডা, জ্বর, নিউমোনিয়ায় বহির্বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফ্ফাত আরা শামসাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিউমোনিয়ার মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। অক্টোবর-নভেম্বর মূলত শিশুদের নিউমোনিয়ার সিজনাল পিরিয়ড। তবে এবার একটু আগেই শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালে শিশুদের মধ্যে এখনো ডেঙ্গু রোগী বেশি। অনেকে ডায়রিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে। সামনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত আরও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিউমোনিয়া একটি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন। অন্যান্য ইনফেকশনে যেমন পরিচ্ছন্ন থাকতে হয় এটাতেও তাই। এ ক্ষেত্রে পরিবারের বড়দের দায়িত্ব নিজে পরিচ্ছন্ন থাকা, হাত ধোয়া এবং শিশুদের পরিচ্ছন্ন রাখা। সাধারণ ঠান্ডাজনিত রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে কি না, জ্বরের পরিমাণ কেমন এগুলো দেখতে হবে। ঠান্ডা লাগলে শিশুদের নাক পরিষ্কার রাখতে হবে। তরল খাবার দিতে হবে। গরম পানিতে লেবু, মধু দিয়ে খাওয়ালে উপকার হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।’ ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি জেলা সদর হাসপাতালে বেড়েছে নিউমোনিয়ার প্রকোপ। আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি শেখ রুহুল আমিন জানান, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে আট শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছে ১১৫ শিশু। অধিকাংশই নিউমোনিয়া আক্রান্ত। ছয় থেকে ১৮ মাস বয়সী শিশুরা বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের শিশু ও নবজাতক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বুকের দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি শিশুদের সুষম খাবার দিতে হবে।’ বাগেরহাট প্রতিনিধি শেখ আহসানুল করিম জানান, বাগেরহাটের শুধু সরকারি হাসপাতালে গত এক মাসে ১০ হাজারের অধিক শিশু নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে চিকিৎসা নিয়েছে। শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংকটের কারণে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাগেরহাট সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শিহান মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেড ২৪টি। গত কয়েকদিনে ধারণক্ষমতার তিন-চার গুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, গত এক মাসে শুধু সদর হাসপাতালে সাড়ে ৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে ভর্তি হয়েছে। এই সময়ে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ১০ হাজারের বেশি শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গুতে ২১ দিনে আক্রান্ত ৫ হাজার ৮৬৬, মৃত্যু ১৩ : ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪৬ জন। ঢাকায় ২১১ আর ঢাকার বাইরে ৩৫ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে চলতি মাসের ২১ দিনে মারা গেছেন ১৩ জন। আর এ মাসে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৮৬৬ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে এসব জানা যায়।