সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে অস্থিরতা

এক বছরে দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, এক বছরে যে হারে দাম বেড়েছে গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম এতটা বাড়েনি

মানিক মুনতাসির

খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন, বণ্টন, সরবরাহ চেইনে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিমধ্যে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে স্থানীয় বাজারে। এর সঙ্গে বাড়তি চাপ যোগ করেছে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি। ফলে সামনের দিনগুলোতে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উৎপাদন বাড়ানো, বণ্টন ও সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে গমের। গত এক বছরে সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। কানাডা, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলোয় গমের ফলন কমেছে। ফলে তারা রপ্তানিতে লাগাম টেনেছে। এর ফলে বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়ছে পণ্যটির দাম। খাদ্যশস্য হিসেবে গম থেকেই প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রধান প্রধান খাদ্য প্রস্তুত করা হয় বিশ্বজুড়ে।

এ ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির হিসাবে তা সর্বোচ্চ।

এর কারণ হিসেবে করোনা মহামারীর পাশাপাশি সর্ববৃহৎ কৃষি দেশ কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি কানাডায় সৃষ্ট বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশটির সর্ববৃহৎ টার্মিনাল ভ্যাঙ্কুভারের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ভ্যাঙ্কুভার টার্মিনালে তৈরি হয়েছে চালান সংকট। এ টার্মিনালের অদূরে সৃষ্টি হয়েছে পণ্যবোঝাই জাহাজের জট। কানাডা বিশ্বের বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও খাদ্যে সরবরাহ চেইনে গভীর সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, বন্যা ও ভূমিধস কানাডার বৃহত্তম এই টার্মিনালটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এ ছাড়া বন্দর এবং উত্তর আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর, ভ্যাঙ্কুভার, সব রেল পরিষেবা থেকে বন্দর কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে বন্দরের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য নক-অন প্রভাব থাকবে দেশের সাপ্লাই চেইনে। রেললাইনের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো বন্দরকে সচল রাখে। আর এই ভ্যাঙ্কুভার বন্দর এলাকায় বৃষ্টি ও ঝড়ের পর বন্যা এবং ভূমিধসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। এ বন্দর সামলাতে সক্ষম উত্তর আমেরিকার কার্গোর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় পরিসর বাল্ক, পাত্রে, ব্রেকবাল্ক, লিকুইড বাল্ক, অটোমোবাইল এবং ক্রুজ। দেশের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই বন্দরের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ১৭০টিরও বেশি দেশে পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়। এদিকে বছরের জুনে জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়ে সতর্ক করেছিল বিশ্ববাসীকে যে, করোনার কারণে ৫০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ আভাস দেন সে সময়। আসন্ন এ বিপর্যয় ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয় ৯ জুন ২০২০। আর গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য রেকর্ডের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্সসহ বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো।

এফএও বলছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত টানা তৃতীয় মাসের মতো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম গত ১০ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর একই সময়ের চেয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্ব সংস্থাটি বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়। এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরবরাহে ঘাটতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্য, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ জলবায়ু পরিবর্তনকেও এ জন্য দায়ী করছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমছে।

অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার দর পর্যবেক্ষণ করে এফএও। এর ভিত্তিতে করা তাদের ‘খাদ্য মূল্যসূচক’ অক্টোবরে ছিল গড়ে ১৩৩ দশমিক ২ পয়েন্ট, যা আগের মাস সেপ্টেম্বরে ছিল ১২৯ দশমিক ২। সংস্থাটি বলছে, ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর এসব পণ্যের দাম আর এতটা বাড়েনি। এফএও বলছে, বিশ্বব্যাপী সব ধরনের খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। অক্টোবরে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ, যা নতুন রেকর্ড গড়েছে। এমনকি সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। টিসিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের (সয়াবিন) দাম এখন ১৫০-১৫৫ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা। আর এক বছর আগে ছিল ৯০-৯২ টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে ভোজ্য তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. আবদুল মুঈদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই কৃষি উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এখানেও এর প্রভাব পড়েছে। এর ফলে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে জরুরি নিত্যপণ্য হিসেবে পরিচিত চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা, পিঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়ছে হু হু করে। মাছ-মাংসের বদলে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির মাংস খেতেন গরিব মানুষ। মাছ, মাংস, ডিম নিয়মিত খেতে না পারলে ডাল, আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করত দিনমজুর। এখন সেই আলুভর্তার দামও বাড়তি। শুধু আলুর দামই বাড়েনি। আলুভর্তা করতে যে তেল, পিঁয়াজ আর মরিচের দরকার, সেই তিনটি পণ্যের দামও এখন আকাশচুম্বী। ফলে স্বচ্ছন্দে আলুভর্তা-ভাতও খেতে পারছেন না গরিব মানুষ। তাই নিত্যদিনের বাজার খরচ মেটাতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। আয়-ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছেন না কিছুতেই। জীবন চালাতে ধার-কর্জ করছেন প্রতিনিয়ত। ডাল-ভাত খেতে নাভিশ্বাস উঠেছে দিনমজুরদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের দেশে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বেশ সন্তোষজনক। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সারা বছরই মৌসুমভেদে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। তবে করোনা-পরবর্তী দাম কিছুটা বেড়েছে। এটা তো আসলে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারী-পরবর্তী সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় এটা স্বাভাবিক। তবে এটাকে যতটা সহনীয় রাখা যায় আমাদের সে চেষ্টাই করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর