ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আটকে পড়া ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের ২৮ নাবিক-ক্রু রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে দেশে ফিরেছেন। গতকাল দুপুরে তাদের বহনকারী তার্কিশ এয়ারের (ইকে-৭২২) একটি ফ্লাইট রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত এসপি মোহাম্মদ জিয়াউল হক এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে রাত পৌনে ২টার দিকে রোমানিয়া থেকে ২৮ নাবিক তার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে রওনা দেন। বুধবার (গতকাল) দুপুরে তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।’ তাদের জন্য বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন পরিবারের সদস্য, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। শাহজালাল বিমানবন্দরে অন্য নাবিকদের গ্রহণ করতে স্বজনরা যখন এলেন আনন্দ নিয়ে, তখন রকেট হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মা রাশিদা বেগম কেবল জানতে চাইছিলেন, হাদিসুরের মরদেহ কবে মিলবে। বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন রাশিদা। বলছিলেন, ‘সবাই আইছে, আমার ছেলে কই?’ এদিকে যুদ্ধের গোলায় সহকর্মীর মৃত্যু দেখা বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের মাস্টার জি এম নূর ই আলম অন্য নাবিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে দেশে ফিরতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেন। নাবিকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সামনে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এত দ্রুত সুস্থভাবে সবাই ফেরা সম্ভব হবে, সেটা ভাবতেও পারিনি। দ্রুততম সময়ে সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করায় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর বিএসসি, নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছিল।’ তাদের বের করে আনার জন্য পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রোমানিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাসকর্মীরা যে পরিশ্রম করেছেন, সে জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ উইংয়ের মহাপরিচালক সিকদার বদিরুজ্জামান বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের ২৮ জন যে ক্রু মেম্বার, তাদের আমরা আমাদের বুকে নিতে পেরেছি। এটা আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের। তারা তাদের পরিবারের কাছে যাবেন, তারা এখন সেইফ। বাকি একজন হাদিসুর রহমান, তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি এবং তার দেহাবশেষ আমরা অতিসত্বর দেশে আনতে পারব। হাদিসুরের লাশ ফেরানোর বিষয়ে পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করছে।’
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ ডেনিশ কোম্পানি ডেল্টা করপোরেশনের অধীনে ভাড়ায় চলছিল। মুম্বাই থেকে তুরস্ক হয়ে জাহাজটি ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নোঙর করে। অলভিয়া থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল জাহাজটির। এরই মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে ২৯ জন ক্রু নিয়ে অলভিয়া বন্দরে আটকা পড়ে জাহাজটি। ২ মার্চ রকেট হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হন। তবে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় হাদিসুর রহমানের মরদেহ এবং জীবিত ২৮ জনকে ৩ মার্চ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। ৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুরে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর-সংলগ্ন বাংকার (শেল্টার হাউস) থেকে বেরিয়ে মলদোভার পথে যাত্রা করেন ওই ২৮ নাবিক। এরপর ৬ মার্চ বেলা ১১টার দিকে তারা ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে মলদোভা হয়ে দুপুরের পর রোমানিয়া পৌঁছান।
দেশে ফেরা বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ২৮ নাবিক-ক্রু হচ্ছেন- জি এম নুর ই আলম, মো. মনসুরুল আমিন খান, সেলিম মিয়া, রমা কৃষ্ণ বিশ্বাস, মো. রুকনুজ্জামান রাজিব, ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি, ফয়সাল আহমেদ সেতু, মোহাম্মদ ওমর ফারুক, সৈয়দ আসিফুল ইসলাম, রবিউল আউয়াল, সালমান সরওয়ার সামি, ফারজানা ইসলাম মৌ, মো. শেখ সাদি, মো. মাসুদুর রহমান, মো. জামাল হোসাইন, মোহাম্মদ হানিফ, মো. আমিনুর ইসলাম, মো. মহিন উদ্দিন, হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব, সাজ্জাদ ইবনে আলম, নাজমুল উদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম, সরওয়ার হোসাইন, মো. মাসুম বিল্লাহ, মোহাম্মদ হোসাইন, মো. শফিকুর রহমান, মো. আতিকুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন।
হাদিসুরের মায়ের আহাজারি : বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলার পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া নাবিকরা যখন নিরাপদে দেশে ফিরলেন, ওই হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ তখনো যুদ্ধের ময়দান ইউক্রেনে। মা রাশিদা বেগম জানেন না, কখন পাবেন ছেলের লাশ; শেষবারের মতো দেখে চিরবিদায় দেবেন প্রিয় সন্তানকে। ইউক্রেনে যুদ্ধের মধ্যে অলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা অবস্থায় ২ মার্চ রকেট হামলার মুখে পড়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি। হামলায় নিহত হন ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর। আতঙ্ক ও ক্ষোভের মধ্যে পরদিন ৩ মার্চ জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নাবিকদের বাংলার সমৃদ্ধি থেকে নামিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে একটি শেল্টার হাউসের বাংকারে ঠাঁই নেন নাবিকরা। পরে মলদোভা হয়ে তারা পৌঁছান রোমানিয়ায়। সেখান থেকে বিমানে দেশে ফেরেন এই জাহাজিরা। তাদের ঢাকায় পৌঁছার খবর শুনে দুপুরে বিমানবন্দরের ভিআইপি ফটকের সামনে উপস্থিত হন নিহত হাদিসুরের পরিবারের সদস্যরাও। দুপুরে ওই ফটকে হঠাৎ করে এসে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বিলাপ করতে থাকেন হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স। তিনি মাতম করতে করতে বলেন, ‘আমার ভাই কই, সবাই আইছে আমার ভাই কই। আমার ভাই মরতে পারে না। আমার ভাইয়ের লাশ চাই।’ হাদিসুরের মা রাশিদা বেগম আর বাবা আবদুর রাজ্জাক মাস্টারের সঙ্গে বিমানবন্দরে ছিলেন হাদিসুরের আরেক ভাই তারিকুল ইসলাম। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বিলাপ করতে থাকেন হাদিসুরের মা রাশিদা।
মাতম করতে করতে আকুতি জানান ছেলেকে ফেরানোর। মাতম করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ছেলের খোঁজ চাইছিলেন হাদিসুরের বাবা রাজ্জাক মাস্টারও। বরগুনার অবসরপ্রাপ্ত মাদরাসা শিক্ষক রাজ্জাকের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে হাদিসুর ছিলেন মেজো। জাহাজে চাকরির সুবাদে বছরের একটি বড় সময় থাকতে হতো বাইরে। সব শেষ বাড়ি এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে কথা হতো নিয়মিত। আহাজারি করতে করতে রাজ্জাক মাস্টার বলেন, ‘আমার ছেলেকে কখন পাব!’