১৪ বছর আগে দুর্নীতি মামলা বাতিল চেয়ে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের আবেদন গ্রহণ করে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দিয়ে এবং বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করে হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের কাজে আইনবহির্ভূত হস্তক্ষেপ করেছেন। ওই সময় আইনের দৃষ্টিতে জোবাইদা রহমান ছিলেন পলাতক। পাঁচ বছর আগে ওই রুল খারিজের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজের রায়ে এমন অভিমত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ১৩ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গতকাল প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। রায়ের অনুলিপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতেও এসেছে।
‘ডা. জোবাইদা রহমান বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য’ শিরোনামের এ মামলার ১৬ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি বোরহানউদ্দিন। রায়ে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।
রায়ে বিষ্ময় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘২০০৮ সালে যেখানে বিচারিক আদালত জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়নি, এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারায় হাই কোর্টে মামলা বাতিলের আবেদনকারী (জোবাইদা রহমান) সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি, সেখানে হাই কোর্ট কীভাবে জোবাইদা রহমানের মামলা বাতিলের আবেদন গ্রহণ করলেন! শুধু তা-ই নয়, হাই কোর্ট বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেওয়ার পাশাপাশি মামলা বাতিল প্রশ্নে রুলও জারি করেছেন!’
রায়ে বলা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারার অধীনে আইন-আদালতের কাছে প্রতিকার চান, তখন ওই ব্যক্তির উচিত বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। তবে কোনো অভিযুক্ত পলাতকের ক্ষেত্রে আদালত তা গ্রহণ করতে পারে না। তখন জোবাইদা রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক। কিন্তু জোবাইদা রহমান সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ না করে সে সময় (২০০৮ সালে) মামলা বাতিলের আবেদন করেছিলেন। ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল সে আবেদন হাই কোর্ট নিজ এখতিয়ার ডিঙিয়ে অবৈধভাবে আমলে নিয়ে মামলা বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করেছেন এবং মামলা কার্যক্রমে স্থাগিতাদেশ দিয়েছেন, যা স্পষ্টত বেআইনি এবং আইনবহির্ভূত।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ উদ্বৃত করে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের চোখে সব নাগরিক সমান এবং সব নাগরিকই আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা ভয় বা পক্ষপাতহীনভাবে আইন অনুসারে বিচারকাজ করার শপথ নিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বিচার বিভাগকে সব সময়ই মাথা উঁচু করে করে থাকতে হবে। এমনকি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিচার বিভাগকে মাথা উঁচু করেই থাকতে হবে। বিচার বিভাগকে এমন কোনো নজির সৃষ্টি করা যাবে না, যা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেক নাগরিকের আদালত থেকে সমান বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনের-আদালতের সামনে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আবেদনকারী (জোবাইদা রহমান) যখন (২০০৮) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারায় মামলা বাতিলের আবেদন করেন, তখন তিনি আইনের চোখে পলাতক ছিলেন।
রায় প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জোবাইদা রহমানকে পলাতক উল্লেখ করে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। ফলে জোবাইদা রহমানকে হাই কোর্টের দেওয়া আত্মসমর্পণের নির্দেশ আর থাকছে না। কারণ তিনি এখন পলাতক। আর এ রায়ের ফলে জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে এ মামলা চলতে আর কোনো বাধা নেই। এখন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় এ মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক রহমানকে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয় জোবাইদা ও তার মায়ের বিরুদ্ধে। সেখানে বলা হয়, তারেক তার স্ত্রীর নামে ৩৫ লাখ টাকার দুটি এফডিআর করে দেন। এভাবে জোবাইদা তার স্বামীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহায়তা করেছেন। এ মামলায় ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। তখন জোবাইদা রহমান মামলাটি বাতিল চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করেন। সে আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর উচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। মামলাটি কেন বাতিল করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। সেই রুলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রায় দেন হাই কোর্ট। মামলাটি বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজ করা হয় রায়ে। সেই সঙ্গে রায়ের অনুলিপি পাওয়ার আট সপ্তাহের মধ্যে জোবাইদা রহমানকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মামলার বিচারকাজ চলতে বাধা কেটে যায়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন জোবাইদা রহমান, যা ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগও খারিজ করেন। নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান মাহবুব আলী খানের মেয়ে জোবাইদা রহমান ১৯৯৫ সালে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। এর দুই বছর আগে তারেকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।