সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। অনেক এলাকায় এখনো পানিতে তলিয়ে আছে বাড়িঘর। বাঁধে আশ্রিতরা বাঁধেই অস্থায়ী সংসার শুরু করেছে। পানি কমতে থাকায় বানভাসিদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিলেও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। কোনো কোনো এলাকায় নতুন করে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নেই। এদিকে বন্যা উপদ্রুত অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছেনি। নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের খবর-
সিলেট : সিলেটে সুরমা, ধলাই, পিয়াইন, লোভা ও সারি নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলো থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৭টিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে অনেক বন্যার্ত বাড়ি ফেরা শুরু করেছেন। তবে কুশিয়ারা তীরবর্তী ছয় উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এখনো সিটি করপোরেশন ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৬৫২টি আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন প্রায় ৯২ হাজার বন্যার্ত।
কুশিয়ারার পানি বেড়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মোল্লাপুর ইউনিয়নের একাংশ ও পৌর সদর ছাড়া পুরো উপজেলা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকার মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। একইভাবে জকিগঞ্জ উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পৌর শহরের একাংশ ছাড়া পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়ে গেছে। সিলেট-শেওলা-জকিগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেট-আটগ্রাম-জকিগঞ্জ ও সিলেট-কালিগঞ্জ-জকিগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন স্থান তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। বাস ও ট্রাক ছাড়া ছোট কোনো গাড়ি ওই দুই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারছে না। বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরিফগঞ্জ, বাদেপাশা, আমুড়াসহ কুশিয়ারা তীরবর্তী সব ইউনিয়নে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে দক্ষিণ সুরমায় প্রবেশ করায় জালালপুর, দাউদপুর, মোগলাবাজার ও সিলাম ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি ফেরা শুরু করেছেন।
ঘরের ভিতর ভাসছিল লাশ : সিলেটের বিয়ানীবাজারে পানিবন্দি ঘর থেকে বাহার উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির ভাসমান লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে বিয়ানীবাজার উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খশির আবদুল্লাহপুর নয়াপাড়ার নিজ বসতঘর থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন স্বজনরা। এক সপ্তাহ ধরে বাহার উদ্দিনের ঘর পানিতে নিমজ্জিত। ঘরে পানি ওঠায় তিনি পরিবার নিয়ে বৈরাগী বাজার সিনিয়র মাদরাসা আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেন। গত বুধবার বিকালে তিনি তার ডুবে যাওয়া ঘর দেখতে গিয়েছিলেন। গতকাল সকালে তার খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা বসত ঘরে পানির মধ্যে তার লাশ ভাসতে দেখেন।
কবরস্থানে পানি রান্নাঘরে দাফন : জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সদরের পানি কিছুটা কমলেও অন্যান্য উপজেলায় বেড়েই চলেছে। কোমরপানিতে ঘরবন্দি মানুষ। বাড়ি থেকে মূল সড়কে যেতে লাগে নৌকা। মরদেহ দাফন করতে হয়েছে রান্নাঘরে। মঙ্গলবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মাদল গ্রামের আলী উসমানের ছেলে সলিমুদ্দিন (৬৫) মারা গেছেন। এলাকার কবরস্থানসহ গ্রামীণ সড়কেও পানি থাকায় রান্নাঘরেই তাকে সমাহিত করেন স্বজনরা।
বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি। পানি কমতে থাকায় বানভাসীদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিলেও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। বাড়িঘর এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। বাঁধে আশ্রিতরা বাঁধেই অস্থায়ী সংসার শুরু করেছে। জেলায় যমুনা নদীর পানি বুধবার বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও গতকাল পানি কমে তা ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
জামালপুর : জামালপুরে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও যমুনা নদীর পানি এখনো বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমলেও বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।
জামালপুরে টানা পাঁচ দিন ধরে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পর গতকাল থেকে কমতে শুরু করেছে।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলার চারটি উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ১ লাখ পরিবার। ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। তাদের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় বন্যা কবলিত চার উপজেলার ১ হাজার ৭০১ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে, আউশ ধান, পাট, শাক-সবজি, আমন বীজতলা, চিনা বাদাম, তিল ও মরিচসহ বিভিন্ন ফসল রয়েছে।
রাজবাড়ী : রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : যমুনার নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে কমলেও এখনো বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পাঁচটি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে বন্যায় পানিবন্দি মানুষের মাঝে দিন দিন বাড়ছে দুর্ভোগ। দেখা দিচ্ছে ত্রাণ, বিশুদ্ধ পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গো খাদ্যের চরম সংকট। এদিকে জেলার নদীগুলোতে পানি কমতে শুরু করলেও কমেনি হাওরের পানি।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ঘর-বাড়ি। এতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে বানভাসিদের।
নেত্রকোনা : পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর জেলার মোহনগঞ্জ রেল লাইনের সর্বশেষ স্টেশন থেকে আটকে থাকা আন্তনগর হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনটি গতকাল সকালে ছেড়ে গেছে ঢাকার উদ্দেশে। এরপর থেকে এক এক করে আসা যাওয়া করছে ট্রেন। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস সন্ধ্যায় যাবে মোহনগঞ্জ। সেখান থেকে আবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমতে শুরু করায় লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি কমে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ও ধরলার পানি শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি এখনো বাড়ছে।
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        