শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

হুমকিতে নিরাপদ খাদ্য

হোটেল-রেস্তোরাঁ-ফাস্টফুডে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দিন দিন মান কমছেই, মূল্যায়ন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের

উবায়দুল্লাহ বাদল

হুমকিতে নিরাপদ খাদ্য

রাজধানীর বেইলি রোডের অভিজাত রেস্তোরাঁ ‘কেএফসি’। এক বছর আগে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএসএফএ) পরিদর্শক টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে খাবারের মান, রান্নার পরিবেশ, পণ্যের মান, পরিবেশনা, পরিবেশনকারীর ও অবকাঠামোগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করে তাদের ‘এ প্লাস’ গ্রেডিংয়ের সনদ দিয়েছিল। অর্থাৎ তারা ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯০-এর বেশি পেয়েছিলেন। কিন্তু সনদ পাওয়ার পর কেএফসি সে সুনাম ধরে রাখতে পারেনি। যেসব বিষয় বিবেচনা করে তাদের ‘এ প্লাস’ দেওয়া হয়েছিল তার প্রায় সবকটির মান নিচে (খারাপ) নেমে গেছে। বিএসএফএর পরিদর্শক টিম সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানে আবারও ঝটিকা পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্র পেয়েছে। ফলে তাদের এক ধাপ নিচের গ্রেডিং ‘এ’ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা এবার ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮৪ পেয়েছেন। প্রায় অভিন্ন চিত্র বেইলি রোডের আরেক নামকরা ফাস্টফুডের দোকান ‘পিজা হাট’-এরও। গত বছর পিজা হাট ‘এ প্লাস’ গ্রেডিংয়ের সনদ পেলেও এ বছর পেয়েছে শুধু ‘এ’। এ চিত্র শুধু বেইলি রোডের নয়, রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা, পুরানা পল্টন, নয়া পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকার নামিদামি হোটেল-রেস্তোরাঁর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর খাবারের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। পোড়া তেল (একই তেল বারবার ব্যবহার) দিয়ে রান্না করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের খাবার। নোংরা পরিবেশে মানহীন খাবার তৈরি করছেন অপরিষ্কার শরীরের হোটেল শ্রমিকরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নেই অধিকাংশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ শ্রমিকের। ফলে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বানানো এসব খাবার দেদার বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর নামিদামি রেস্তোরাঁগুলোয়। এসব মানহীন খাবার খেয়ে বাড়ছে মানুষের রোগবালাই। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ।

জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে সবকিছুর মতো গ্রেডিং নির্ধারণের কাজেও শিথিলতা আসে। করোনার পর গ্রেডিংয়ের বিষয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন সরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজধানীর আগের গ্রেডিংকৃত ৪০টি হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড ও মিষ্টির দোকান পুনঃপরিদর্শন করে। এতে দেখা গেছে, খাবারের মান, রান্নার পরিবেশ, পণ্যের মান, পরিবেশনা, পরিবেশনকারীর ও অবকাঠামোগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য বিষয়ে মান খারাপ হয়েছে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের। আগের মতোই আছে অর্থাৎ কোনো উন্নতি হয়নি ২০টির এবং খারাপ অবস্থা থেকে উন্নতি হয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠানের। গতকাল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে মূল্যায়নকৃত খাদ্য স্থাপনার গ্রেড প্রদান অনুষ্ঠানের এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড ও মিষ্টির দোকানকে নতুন করে গ্রেডিং সনদ প্রদান করে বিএসএফএ। বিএসএফএর সদস্য শাহনেওয়াজ দিলরুবা খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবদুল কাইউম সরকার। যাদের মান খারাপ হয়েছে অনুষ্ঠানে তাদের দেড় মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। আসছে আগস্টের মাঝামাঝি এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ সরেজমিন পরিদর্শন করবে প্রতিষ্ঠানটির পরিদর্শক টিম। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি বলেন, ‘আমরা আমাদের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় শতভাগ নিরাপদ খাবার সরবরাহ করতে চাই। কিন্তু আমাদের হোটেল শ্রমিকরা যেহেতু স্বল্পশিক্ষিত বা কেউ কেউ লেখাপড়াহীন- তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেহেতু তারাই হোটেলগুলোয় খাবার তৈরি ও সরবরাহ করেন।’ প্রায় অভিন্ন দাবি জানান ঢাকা মহানগরী উত্তরের হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান চৌধুরী বিপু। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি শতভাগ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে চায় তাহলে অবশ্যই হোটেল শ্রমিকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তারা যখন বুঝবেন এটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তখনই শতভাগ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে।’ গত এক বছরে গ্রেডিং নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- রাজধানীর পুরানা পল্টনের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মরণির জিএফসি রেস্টুরেন্ট, খানা বাসমতী, নয়া পল্টনের ওয়াসটন রেস্টুরেন্ট, নয়া পল্টন ভিআইপি রোডের ঢাক্কা কুইসিন ও মিডনাইট সান-৩, সেগুনবাগিচার বাগিচা রেস্টুরেন্ট, নয়াপল্টন বিজয়নগরের মৌরী রেস্টুরেন্ট, ডেমরা রোডের কাজলার পাড়ের রোজ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এ ছাড়া গ্রেডিং ‘এ’ থেকে সরাসরি ‘সি’তে নেমেছে রাজধানীর খিলগাঁও তালতলার কফি লাইম ও মি. বার্গার ফাস্টফুড। ‘বি’ থেকে ‘সি’তে নেমেছে একই এলাকার পপি’স কফি হাউস। এ ছাড়া খাবারের মান ও পরিবেশ উন্নতি করেছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- গাজীপুরের কালীগঞ্জের মিথি, রাজধানীর পুরানা পল্টনের ক্যাফে বিসমিল্লাহ ও হান্ডি, খিলগাঁও তালতলার ভূতের আড্ডা, নর্থ কাফরুলের ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানের সাথী-মিথি এবং সাভার হেমায়েতপুরের বনফুল অ্যাণ্ড কোং। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবদুল কাইউম সরকার বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে রি-গ্রেডিংয়ে আগের চেয়ে মান কমেছে বেশ কয়েকটি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের। অনেকের মানের উন্নতি হয়েছে। আবার কারোটা আগের অবস্থানেই রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম যাদের মান উত্তম তারা সারা বছর সেটা ধরে রাখবেন। যাদের খারাপ ছিল তারা দ্রুত মান উন্নতি করবেন। কিন্তু মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উন্নতি করলেও অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই আগের অবস্থানে রয়েছে। অথচ তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নতি করার কথা ছিল। আগামীতে আমরা এ গ্রেডিং পদ্ধতি সারা দেশের শহরে চালু করব। সে অনুযায়ী ডাইরেক্টরি তৈরি করে প্রকাশ করা হবে। মানুষ যেন জেলা শহরগুলোয় গেলেই জানতে পারে কোন হোটেল-রেস্তোরাঁয় নিরাপদ খাবার পাওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে জনসচেতনতা, পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং ভেজালবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হবে। বিএসএফএ সূত্র জানিয়েছেন, করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে রাজধানীসহ আশপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর মান নির্ধারণ কাজ শুরু করেছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর ৫৭টি হোটেল-রেস্তোরাঁকে গ্রেডিং পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘এ প্লাস’ পেয়েছিল ১৮টি এবং ‘এ’ গ্রেড ৩৯টি। রাজধানীর ২০০ হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে এগুলোকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। খাবারের মান, রান্নার পরিবেশ, পণ্যের মান, পরিবেশনা, পরিবেশনকারীর ও অবকাঠামোগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ গ্রেডিং করা হয়। এ ক্ষেত্রে ‘এ প্লাস’, ‘এ’ ছাড়াও ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিও রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, খাবারের মান, বিশুদ্ধতা, পরিবেশ, ডেকোরেশন, মনিটরে রান্নাঘরের পরিবেশ দেখা যাওয়ার ব্যবস্থা ও ওয়েটারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ভিত্তিতে রেস্তোরাঁগুলোকে চার ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব হোটেল-রেস্তোরাঁ ৯০ নম্বরের বেশি স্কোর পাবে তারা ‘এ প্লাস’, স্কোর ৮০-এর ঊর্ধ্বে হলে ‘এ’, ৫৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত স্কোর হলে ‘বি’ এবং ৪৫ থেকে ৫৫ স্কোর হলে ‘সি’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত হবে। এ প্লাস পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তম মানের এবং এ গ্রেড প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো মানের হোটেল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব হোটেলের সামনে ‘এ প্লাস’ হলে সবুজ, ‘এ’ হলে নীল, ‘বি’ হলে হলুদ এবং ‘সি’ হলে কমলা রঙের স্টিকার লাগানো থাকবে। কমলা রঙের স্টিকার দেখলে বুঝতে হবে হোটেলটি অনিরাপদ। এ হোটেলকে এক মাসের মধ্যে মান ভালো করতে হবে। না হলে হোটেলের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। অন্যদিকে হলুদ স্টিকারধারী রেস্তোরাঁকে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে তাদের মান ও গ্রেড উন্নত করতে হবে। অন্যথায় তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। যারা রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে যাবেন তারা প্রবেশের সময় স্টিকার দেখেই জানতে পারবেন, এ হোটেল খাবারের জন্য কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, রান্নাঘরের অভ্যন্তরের পরিবেশ কেমন ইত্যাদি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর