শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
বিদ্যুৎ সঞ্চালনই মূল চ্যালেঞ্জ

আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি থেকে গ্রিড বিপর্যয়

জিন্নাতুন নূর

আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি থেকে গ্রিড বিপর্যয়

সরকার দেশের শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিলেও সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে এখনো পিছিয়ে। ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা এই পিছিয়ে পড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। তারা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার বড় বড় কেন্দ্র নির্মাণে গুরুত্ব দিলেও সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এ জন্য বিদ্যুৎ খাতের সফলতায় সরকারের এখন মূল চ্যালেঞ্জই হবে বিদ্যুতের সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন যে, বিদ্যুৎ বিতরণে আওয়ামী সরকার যতটা এগিয়েছে, সঞ্চালনে সেভাবে এগোতে পারেনি। এ জন্য আরও আধুনিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, ‘বিদ্যুতের সিস্টেম ম্যানেজ করতে হলে এই ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতেই হবে। আমাদের অনেক সঞ্চালনে পুরনো লাইন আছে। সেই লাইনগুলোতে ঝামেলা আছে। পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে ম্যানেজ করে জাতীয় লোড ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র (এনএলডিসি)। এ জন্য যোগাযোগব্যবস্থায় এনএলডিসির আধুনিকায়নের দরকার আছে। এটিই সবচেয়ে জরুরি। এর বাইরে বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এ জন্য চেষ্টাও করা হচ্ছে। তবে নতুন লাইন স্থাপনেই বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। যে অর্থ খরচ হচ্ছে এর বেশির ভাগই নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর লাইন নির্মাণে। কিন্তু পুরনো লাইন সংস্কারে বা প্রতিস্থাপনে খুব বেশি প্রকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এনএলডিসিকে অটোমেটেড করা। বাংলাদেশে যারা লোড ডিসপেচিংয়ের কাজ করে, যারা এই সিস্টেমকে স্ট্যাবল রাখে, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাদের স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করতে হবে।’ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল  বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত অটোমেশনে যাব, তত দ্রুত সমস্যা কমে আসবে। আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। করোনার কারণে দুই বছর আমাদের অনেক কাজ পিছিয়ে গেছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) অনেক কাজে পিছিয়ে আছে। বিতরণে আমরা যতটা এগিয়েছি, সঞ্চালনে সেই তুলনায় এগোতে পারিনি। আরও আধুনিকতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে।’ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সঞ্চালন ব্যবস্থায় যেখানে জটিলতা সেখানেই দুর্ঘটনা ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চালন ব্যবস্থার জটিলতার কারণে এ ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটবে। আমরা আমাদের লাইন আপগ্রেড করার কাজ করছি। কিন্তু যেভাবে এ কাজ হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়তো হয়নি। কিন্তু এখন আমরা সঞ্চালন ব্যবস্থা জোরদারের ওপর কাজ করছি।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে এর আগে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর আধুনিক সঞ্চালন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করা হলেও এখনো তা গড়ে ওঠেনি। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় এখনো রয়েছে দুর্বলতা। এর আগে ২০০৭ ও ২০১৪ সালে দেশে দুটি বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর সঞ্চালন অবকাঠামো আধুনিক করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এরপর সঞ্চালন খাতে নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। বর্তমানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতে মোট ১৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে আটটি প্রকল্প আগের অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ বছর মাত্র একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আর বাকি আটটি প্রকল্পের মেয়াদ চলমান। দেশে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করে পিজিসিবি। পিজিসিবির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রিড লাইনের এক সেকেন্ডের জটিলতা দীর্ঘ সময়ের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এটি যে কোনো সময় ঘটতে পারে। তবে ভোল্টেজ ওঠানামা বা ওভারলোডের মতো জটিলতা দেখা দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। পিজিসিবির সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময়ে দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে এ দুর্বলতার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গ্রামে ছড়ানো-ছিটানো লাইন, সিস্টেম দুর্বলতা, পুরনো প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়কে দায়ী করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না করায় বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। পদ্মা নদী পার করে আসা সঞ্চালন লাইন ঢাকার সঙ্গে যুুক্ত করা যায়নি বলে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসিয়ে জরিমানা (ভাড়া) দিতে হয়েছে দেড় বছর। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এ মাসে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও এখনো নিশ্চিত হয়নি সঞ্চালন। ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ আসার কথা। কিন্তু এটিরও সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হয়নি। একইভাবে সঞ্চালন লাইন নিয়ে জটিলতার কারণে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প রূপপুর থেকেও সময়মতো বিদ্যুৎ আনা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি পুরনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে সক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। আবার সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি বা বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সচিবালয়ে গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৪ অক্টোবর সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের নিচে নেমে যায় এবং আন্ডারফ্রিকোয়েন্সির কারণে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা আনস্ট্যাবল হয়ে পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ট্রিপ করে। এতে বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে হলে অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, সঞ্চালন টাওয়ার বসানোর জন্য অনেক মানুষের জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা আছে। বর্তমানে সঞ্চালন লাইন আছে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮০ কিলোমিটার। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন হবে ২৮ হাজার কিলোমিটার। গত এক যুগে সঞ্চালন লাইন বেড়েছে ৫ হাজার ৮৮০ কিলোমিটার।

সর্বশেষ খবর