শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

জ্বালানি সংকটে শিল্প খাত

রুহুল আমিন রাসেল

জ্বালানি সংকটে শিল্প খাত

ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে সারা দেশের শিল্প খাত। এই সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিল্পের উৎপাদন খরচ। এমন তথ্য দিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন- চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ নেই। ফলে উৎপাদন ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বন্ধ। কঠিন সময় অতিক্রম করছে শিল্প খাত। জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি সংকট পুরো অর্থনীতিকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম               উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে শিল্প খাত। সংকটের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন খরচ। জ্বালানির এই দীর্ঘমেয়াদি সংকট পুরো অর্থনীতিকে স্থবির করে দিতে পারে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের  প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ¦ালানি খাতে বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিও পর্যাপ্ত জ¦ালানি ব্যবহারকে বিঘ্নিত করছে। দেশের শিল্প খাত চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাচ্ছে না। এতে শিল্পের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর একক নির্ভরতা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। সংকট উত্তরণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।

বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে।

তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বস্ত্র খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্র কলগুলো গ্যাস-সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে কারখানাগুলো উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, গ্যাস সংকটের কারণে তার কারখানায় উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। কারণ গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময় ও চাহিদামতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। এতে রপ্তানি যেমন কমছে তেমনি শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা ওভারটাইম করতে পারছেন না।  ফলে তারা বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা বারবার সরকারের সঙ্গে এই গ্যাস সমস্যা নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কোনো সমাধানের আশ্বাস পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গ্যাসের সঙ্গে ডলার সংকট এবং ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা সংকটে আছি। যেসব কারখানা পুরোপুরি গ্যাসের ওপর নির্ভশীল তাদের উৎপাদন কমে গেছে। আর যাদের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে উচ্চমূল্যে জ্বালানি তেল কিনে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা মনে করেন, জ্বালানি সংকটের সমাধান না হলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে তাদের ওপর চাপ বাড়বে। অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়বেন। উৎপাদন বন্ধ থাকায় তা কর্মসংস্থানের ওপরও প্রভাব ফেলবে। তারা জানান, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কারণে উদ্যোক্তাদের এখন গলদঘর্ম অবস্থা। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে মূল্যবান জ্বালানি দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এর ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আবার বাংলাদেশ যেসব দেশে পণ্য রপ্তানি করে সেসব দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আদেশ কমছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা কৃচ্ছ্রসাধন করছেন। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো সংকটের মধ্যে পড়েছে। বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ বলছে, প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়ে আড়াই ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। কাপড় রং করার ডায়িং কারখানাগুলোও লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে আজকে এ অবস্থা তৈরি হতো না। পেট্রোবাংলা তাদের আশ্বস্ত করেছিল, অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। নভেম্বরে আরও ভালো থাকবে। ডিসেম্বরে কোনো সংকট থাকবে না। কিন্তু উন্নতি তো দূরের কথা, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

তাদের শঙ্কা, আগামী দুই মাসে গ্যাসের সংকট আরও বাড়বে। গ্যাস-সংকটে উৎপাদন এখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। হুমকির মুখে পড়েছে ১ কোটি ৬০ হাজার ডলারের বিনিয়োগ। ১০ লাখ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উৎপাদন করা না গেলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কাও তীব্র হবে।

বিভিন্ন শিল্প-কারখানার চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- সেখানকার কারখানাগুলোতে দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। অনেকে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন। বড় কারখানাগুলোয় দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলো গ্যাস সংকটে ভুগছিল। টেক্সটাইল, সিরামিকসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জ্বালানি নির্ভর করে গ্যাসের ওপর। গ্যাস-সংকটের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ বাড়ছে উদ্যোক্তাদের।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর তথ্য বলছে, জ¦ালানি নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শিল্প, বাণিজ্য, উৎপাদন এবং আর্থিক কার্যক্রম, যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎনির্ভর। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উপাদান জ¦ালানি তেল ও গ্যাস। বর্তমানে বছরে মোট ৯৯৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, যার ৪৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, ১৫ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ার শিল্প, ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি, ৫ শতাংশ সার-কারখানায়, ৪ শতাংশ  সিএনজি, ১ শতাংশ বাণিজ্যিক এবং দশমিক ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় চা বাগানে।

এফবিসিসিআই বলছে, দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপক ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বাড়ানো বিশেষ করে, নিজস্ব কয়লার ব্যবহার বাড়ানো, সাশ্রয়ী জ্বালানি কৌশল ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। শিল্প-কারখানার জন্য তেলের বিকল্প খুঁজতে হবে। কয়লা, এলপিজি, বায়োগ্যাসের প্রতি আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে। ২০১৩ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর গত আট বছরে একটা কূপ খনন করা হয়েছে। এ  ব্যাপারে আমাদের আরও তৎপর হতে হবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এনার্জি সম্পদ হচ্ছে কয়লা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কয়লা এক্সপ্লোরেশন ছাড়া এনার্জি খাতে নিশ্চয়তার বিকল্প নেই। এলপিজি ছাড়া প্রাথমিক এনার্জি সরবরাহ ও আমদানি শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এফবিসিসিআই বলছে, বেসরকারি খাতকে আমদানি ও বিপণনের অনুমতি দেওয়া হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূল্যহ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া একটি বিশেষ তহবিল গঠন করার মাধ্যমে বছরে অন্তত ১০টি গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। নেট-মিটারিং সিস্টেমে সৌর বিদ্যুৎকে ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার করা সম্ভব। সৌর বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নেট-মিটারিং সিস্টেমের মাধ্যমে ন্যাশনাল গ্রিডে জমা রাখা যায়। কিন্তু নেট-মিটারিং পলিসিতে ইন্সটলের মাত্রা লোডের ৭০ শতাংশ হতে হবে বলা আছে। এই ইন্সটল লোডের লিমিটেশন উঠিয়ে নিতে হবে। ইপিজেডের কারখানাগুলোর ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা সহজতর করতে বেপজাকে উদ্যোগী হতে হবে।

এফবিসিসিআই মনে করে, বর্তমানে দেশের এনার্জি সংকট সৃষ্টি হয়েছে এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ার ফলে। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে, যা এখন ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। এফবিসিসিআই বলছে, সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে জ¦ালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলে খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আপাতত দেশের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, এসি ব্যবহারে সংযমী হওয়াসহ বেশকিছু ব্যয় সংকোচনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এফবিসিসিআই আরও বলছে, বর্তমান আপৎকালীন আমরা এসব উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহে লোডশেডিং করার ক্ষেত্রে শিল্প, কৃষি ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায় উৎপাদন বিঘ্নিত হলে যেমন সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটবে তেমনি রপ্তানিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমান সংকটময় সময়ে রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রমকে কোনোভাবেই ব্যাহত করা যাবে না। আবার অতিমাত্রায় শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং মূল্যস্ফীতিও বাড়িয়ে দিতে পারে। মূলত বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের অপচয় নিরসনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে- এ খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যেই। তবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পেলে, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেলে তখন শ্রমিকের বেতনও বৃদ্ধির দাবি আসবে। যা পণ্যমূল্যের ওপর দ্বিগুণ প্রভাব ফেলবে। এতে আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা দেখা দেবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর