বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায়

জুলকার নাইন ও শাহেদ আলী ইরশাদ

উৎকণ্ঠা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায়

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে ফের সংশয় তৈরি হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে খোদ সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। বিভিন্ন ক্যাম্পের একের পর এক সোর্সের ওপর হামলা ও খুনের ঘটনায় প্রকাশ করা হয়েছে উৎকণ্ঠা। দেশের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠে এসেছে এ উদ্বেগ। পাশাপাশি নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কার কথাও এসেছে বৈঠকে। এজন্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার নবম বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুসারে, সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বৈঠকে বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অপরাধ ও মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য ক্যাম্পের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। ক্যাম্পের ভিতরে যারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন তাদের ওপর আক্রমণও বেড়েছে। এজন্য ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নজরদারি ও তল্লাশি বাড়ানো প্রয়োজন।

সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অপরাধ ও মাদকের ব্যবহার বেড়েছে। ক্যাম্পের ভিতর যারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন, তাদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। ক্যাম্পের চারদিকে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে, এর বিভিন্ন অংশ কেটে ফেলা হচ্ছে। অন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বলেন, শুধু নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরের অপরাধ হ্রাস করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। তিনি বৈঠকে জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারের মোবাইল সিম ব্যবহারের প্রবণতা অধিক। তারা এসব সিম ব্যবহার করে মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গা ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এর ফলে গোয়েন্দা তথ্য উদ্ঘাটনে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তিনি রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে প্রচলিত মোবাইল কোম্পানির সিম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে সভার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৈঠকে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা তুলনামূলক ভালো আছেন, এ অবস্থা দেখে মিয়ানমার থেকে আরও ৬-৭ লাখ রোহিঙ্গা হয়তো বাংলাদেশে চলে আসার প্রচেষ্টা চালাবেন। পুলিশের বিশেষ শাখার পক্ষ থেকে বলা হয়, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাতের ফলে রোহিঙ্গাদের পুনরায় ঢল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বৈঠকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার তার অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে, কিন্তু বাংলাদেশ অংশে কাঁটাতারের বেড়া নেই। বর্তমানে মিয়ানমার আর্মি ও আরাকান আর্মির মধ্যে সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র সংঘাত চলছে। সীমান্তের এ অংশে বিজিবির জোয়ানরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন তবে তা অপ্রতুল। যেকোনো সময় সীমান্তের কাছে অপেক্ষারত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ অংশে পুশইন করানোর আশঙ্কা আছে। তাই ঘুমধুম পয়েন্ট থেকে এ অংশে কাঁটাতারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় সভায়। কার্যবিবরণী অনুসারে, সভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বলেন, কতিপয় রাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশে অবস্থানরত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের যেন বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। কিন্তু এটা করা হলে এই রোহিঙ্গা নাগরিকদের কোনোভাবেই তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো দরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই এ সংকটের একমাত্র সমাধান। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মোবাইল সিম কেনার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। যেহেতু রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়নি বা বর্তমান সরকারের দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই সেহেতু রোহিঙ্গা নাগরিকদের মোবাইল সিম প্রদানের বিষয়ে আইনের পর্যালোচনা প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি এতদিন দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই রোহিঙ্গা নাগরিকদের মোবাইল সিম প্রদান করা হয়নি। তাই রোহিঙ্গাদের সিম প্রদানের বিষয়ে এ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ভবিষ্যতে প্রস্তাব পাওয়া গেলে পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেনা সদর দফতরের পক্ষ থেকে এফডিএমএন ক্যাম্পের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনের জন্য ২৮২ শতক জমির প্রয়োজন। এ বিষয়ে জটিলতা নিরসনের জন্য সেনা সদরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। সভায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের কাজ সন্তোষজনক। নিরাপত্তা বেষ্টনী ১০০ শতাংশ, ওয়াকওয়ে ৯৬ শতাংশ, কালভার্ট ৯৭ শতাংশ, ওয়াচ টাওয়ার ১০০ শতাংশ, নিরাপত্তা বাতি ৭৯-৮০ শতাংশ ও চেকপোস্টের কার্যক্রম ১০০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে কন্ট্রোল রুম ও বাসস্থান নির্মাণকাজের অগ্রগতি কম। নয়াপাড়া ও হোয়াইক্যং ক্যাম্পের জন্য চাওয়া জমির বরাদ্দ/অনাপত্তি পাওয়া যায়নি। এটা জরুরি ভিত্তিতে পাওয়া না গেলে পুরো প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

সভায় রোহিঙ্গাসংক্রান্ত যত সিদ্ধান্ত : আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক স্বাক্ষরিত কার্যবিবরণীতে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ আছে, তা হলো- ক্যাম্পের চারদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ, ক্যাম্পের অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রাখা, সীমান্তে কঠোর নজরদারি অব্যাহত রাখা, উখিয়া থেকে টেকনাফ রাত্রিকালীন যৌথ টহল জোরদার, নয়াপাড়া ও হোয়াইক্যং ক্যাম্পের জন্য জমির জটিলতা দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া, মিয়ানমার থেকে নতুন করে যেন অবৈধভাবে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সেদিনে কঠোর নজরদারি, কোনো অবস্থায়ই রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি না করতে কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর