শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদায় জাতীয় অর্জনের বছর

♦ গর্বের পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল ও স্বপ্নের মেট্রোরেল বাস্তবায়ন ♦ দেশের মুকুটে নতুন সাফল্যের পালক যুক্ত করেছেন বাংলার মেয়েরা ♦ শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও জনশক্তি রপ্তানির রেকর্ড ♦ কাঁদিয়েছে সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোর আগুন ও পঞ্চগড়ের নৌকাডুবি ♦ ভুগিয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব

জুলকার নাইন

বিদায় জাতীয় অর্জনের বছর

শেষ হলো আরেকটি বছর। মহামারির দুই বছর পরের ২০২২ সাল ছিল বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জের বছর। দেশ হিসেবে এ চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ২০২২ সাল ছিল বাংলাদেশের বেশকিছু জাতীয় অর্জনের বছর। এ বছরই বাস্তবায়ন হয়েছে গর্বের পদ্মা সেতু। ঢাকায় চলতে শুরু করেছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। দেশের মুকুটে নতুন সাফল্যের পালক যুক্ত করেছেন বাংলার মেয়েরা। এ বছরই দুর্গম পাহাড় থেকে শুরু করে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ পর্যন্ত শতভাগ স্থানে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। অবশ্য এসবের বাইরেও সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোর আগুন ও পঞ্চগড়ের নৌকাডুবিতে শতাধিক মৃত্যু কাঁদিয়েছে দেশবাসীকে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব ভুগিয়েছে জনগণকে। বিদায়ী ২০২২ সালে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বহু আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। যার দ্বার খুলেছে    এ বছরের ২৫ জুন। এর মাধ্যমে দেশে সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এ সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২১ জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। কংক্রিট আর ইস্পাতের কাঠামোয় পদ্মা নদীর দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধও তৈরি হয়েছে। তবে এ সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা’ প্রকল্প। এ সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ দেশি অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

বছরের একেবারে শেষে মেট্রোরেল লাইন-৬ চালুর মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন এক দুয়ার উন্মোচিত হলো ঢাকাবাসীর জন্য। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ এক অবকাঠামো চালুর পর যোগাযোগ খাতের আরেক মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল লাইন-৬ চালু হওয়া ছিল বাঙালি জাতির এক পরম পাওয়া। বহুল প্রতীক্ষিত এ মেট্রোরেল নগরবাসীকে যানজট থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।

বিদায়ী ২০২২ সালে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে সাবিনা খাতুন, সানজিদা ইসলাম, রুপনা চাকমাদের হাত ধরে প্রথম কোনো বড় শিরোপা নিজেদের করে নিতে পেরেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল; যা নারীদের জন্য এবং সমসাময়িক বাংলাদেশের ফুটবলের জন্যই সবচেয়ে বড় সাফল্যের ঘটনা। ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে দেশে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেন বাংলার মেয়েরা। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বুকে সাফল্য উদ্যাপন করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করা হয়। চলতি বছরের শুরুতে ২১ মার্চ উৎপাদনে আসে দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা তাপভিত্তিক কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এদিন বছরের মার্চেই দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছে দিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিতের ঘোষণা দেয় সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ হিসেবে ঘোষণা দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। যদিও বছর শেষে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ে অর্ধেক দেশের দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্লাকআউটে চলে যাওয়া ছিল ২০২২ সালের অন্যতম ঘটনা। করোনা পরিস্থিতিতে এলোমেলো হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের শ্রমবাজার ২০২২ সালে ফিরেছে ভিন্নমাত্রার গতিতে। অনেক বছর বন্ধ থাকার পর চলতি বছর মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি আবার শুরু হয়েছে। এ বছরই ভেঙেছে এক বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর রেকর্ড। কয়েকটি দেশের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, কিছু দেশের সুযোগ আরও বাড়ানো হয়।

টানা দুই বছর করোনার নেতিবাচক অভিঘাত কাটিয়ে ২০২২ সালের শুরুতে আর্থিক খাতের অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়। তবে ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের মতো টালমাটাল করে তোলে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। ভয়াবহ চাপ পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। বছরের মাঝমাঝি হুহু করে কমতে থাকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন থেকে নেমে বছর শেষে হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে টান পড়ায় সৃষ্টি হয় চরম ডলার সংকট। ৮৫ টাকার ডলার ওঠে ১২০ টাকায়। আমদানির ওপর কড়াকড়ি আরোপে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারার প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ে লাগামহীনভাবে। গুজবে কান দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন অনেক গ্রাহক; যা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। তবে বছর শেষে এ প্রবণতা কমে আসে।

২০২০ ও ২০২১-এ যে করোনা মানুষের জীবন স্থবির করে দিয়েছিল, সেই করোনা ২০২২ সালে দুর্বল হয়ে পড়ায় নিজের শক্তি দেখাতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে এ বছর। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সবকিছুই উন্মুক্ত হয়েছে। শিক্ষা, পর্যটন কিংবা ব্যবসা সবই স্বাভাবিক। তবে করোনা স্তিমিত হলেও বছরটিতে দাপট দেখিয়েছে ডায়রিয়া আর চোখ রাঙিয়েছে ডেঙ্গু। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে ৪ জুন। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণের পর এখনো আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে এগিয়ে আসে। ওই ঘটনায় ৪৯ জন নিহত এবং ৭০ জনের বেশি আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিএম কনটেইনার ডিপোয় ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৩০ জন। শতাধিক যাত্রী নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশে যাচ্ছিল।

বছরের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর। ফিরতি সফর হিসেবে প্রায় তিন বছর পর শেখ হাসিনা ভারত সফরে যান চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। সফরে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে ঘোষণা দিয়েও শেষ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর স্থগিত হওয়ায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী দ্বীপরাষ্ট্র ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ চলতি বছর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন। দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। এ বছরে অন্যতম হিসেবে আলোচনায় ছিল বারবার ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের কোড অব কনডাক্ট (আচরণবিধি ও শিষ্টাচার) ভঙ্গের অভিযোগ। গত নির্বাচন ও আগামী নির্বাচন নিয়ে একাধিক রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য-বিবৃতিতে গরম হাওয়া বয়ে যায় কূটনৈতিক অঙ্গনে। এর মধ্যে শাহীনবাগে একটি বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের যাওয়া নিয়ে তৈরি হয় শোরগোল। বিশ্বপরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসে বাংলাদেশ নিয়ে। বিদায়ী বছরে আরেকটি বড় ঘটনা ছিল মিয়ানমার সীমান্তে ক্রমাগত গোলা বিস্ফোরণ ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা এসে হতাহত হওয়া।

বছরের শেষের দিকে এসে উত্তপ্ত হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশেষ করে প্রায় তিন মাস ধরে সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিশেষ বার্তা দেয় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। রাজধানীতে আলোচিত ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। তাদের ছয় সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। এর বিপরীতে রাজপথ দখলে রেখেই রাজনীতি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বছর শেষে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দশমবারের মতো সভানেত্রী নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে টানা তৃতীয় মেয়াদে থেকে যান ওবায়দুল কাদের। বিদায়ী ২০২২ সালেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনিয়মের কারণে জাতীয় সংসদের একটি আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন চলাকালে ঢাকায় থেকে সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং করে এ সিদ্ধান্ত দেয় ইসি। এ বছরই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন আইন করেছে জাতীয় সংসদ। সে আইনেই ২৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর