শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

জুমার নামাজ আদায়ে তুরাগ তীরে লাখো মুসল্লির ঢল

খায়রুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন, টঙ্গী ইজতেমা ময়দান থেকে

জুমার নামাজ আদায়ে তুরাগ তীরে লাখো মুসল্লির ঢল

টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ছাড়িয়ে জুমার নামাজ আদায়ে মুসল্লির ঢল ছিল সড়কেও

৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব গতকাল শুরু হয়েছে। এ পর্বে জুমার নামাজে ইমামতি করেন কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা যোবায়ের। তুরাগ নদ ঘিরে ১৬০ একর এলাকা ইজতেমা ময়দান প্রথম পর্ব শুরুর আগের দিন বৃহস্পতিবারই মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে যায়। ময়দানে প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে ইজতেমায় আগতরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ আশপাশের সড়ক ও অলিগলিগুলোয় শামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নেন। গতকাল জুমার নামাজে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও পার্শ¦বর্তী জেলাগুলো থেকে অতিরিক্ত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি অংশ নিতে আসায় পরিস্থিতি অন্য রকম আবেশ তৈরি করে।

তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গতকাল দুপুর পৌনে ২টায় জুমার নামাজ শুরু হয়। ইজতেমা ময়দানের মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও পার্শ¦বর্তী জেলাগুলো থেকে ভোর থেকেই ইজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে। বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠের দিকে ছুটে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে ইজতেমা মাঠ উপচে আশপাশের খোলা জায়গাসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে স্থান না পেয়ে মুসল্লিরা সড়ক-মহাসড়ক, বাসাবাড়ির ছাদে ও অলিগলিসহ যে যেখানে পেরেছেন চটের বস্তা ও খবরের কাগজ বিছিয়ে জুমার নামাজে শ?রিক হয়েছেন। জুমার নামাজের অনেক আগেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জোবায়ের অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা জহির ইবনে মুসলিম বলেন, এবার রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়েছে।

জুমার নামাজে ভিআইপি : গতকাল জুমার নামাজে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক, রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. আজমত উল্লা খান, গাজীপুর সিটি মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) আসাদুর রহমান কিরণ, গাজীপুর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম। গতকাল ফজরের নামাজের পর মাওলানা জিয়াউল হকের উর্দুতে চূড়ান্ত আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আমলি শুরাদের তত্ত্বাবধানে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের ইজতেমা শুরু হয়। ইজতেমাস্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দুতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তা তরজমা করা হয়। পরে তাবলিগ মারকাজের শুরা সদস্য ও বুজর্গরা ইমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন। সকাল ১০টায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উদ্দেশে বিশেষ বয়ান করেন আলীগড়ের প্রফেসর সানাউল্লাহ। একই সময় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বয়ান করেন পাকিস্তানের ড. নওশাদ। মাঠে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে বয়ান করেন হায়দরাবাদের মাওলানা আকবর শরীফ। আরব জামাতের উদ্দেশে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইবরাহীম দেওলা। বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়ের জুমার খুতবা পড়েন এবং জুমার নামাজের ইমামতি করেন। জুমার পর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল গোদরা। এরপর বাদ আসর মাওলানা জোবায়ের আহমদ ও বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আহমদ লাট বয়ান করেন। বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক। আজ শনিবার বাদ ফজর বয়ান করবেন মাওলানা খুরশিদ, বাদ জোহর মাওলানা ফারুক, বাদ আসর মাওলানা যোবায়ের আহম্মেদ, বাদ মাগরিব মাওলানা ইব্রাহিম। আয়োজকরা বলেছেন, এ বছরও ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে যৌতুকবিহীন বিয়ে হবে না।

বয়ান : গতকাল বয়ানে বলা হয়- ‘পৃথিবীতে ইমানের মূল্য অনেক বেশি। ইমানকে মজবুত করতে হলে আমাদের দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে। আমরা যেন আল্লাহপাকের হুকুম মতো সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দ্বীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। নিজের আমল দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল (সা.) যে কাজে খুশি হন তা আমাদের বেশি বেশি করতে হবে। আমাদের সবার আখিরাতের চিরস্থায়ী জিন্দেগির জন্য আবাদ করতে হবে।’

বিদেশি মেহমান : ইজতেমার প্রথম পর্বের গণমাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম জানান, গতকাল পর্যন্ত সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, জর্ডান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ৭৫টি দেশের প্রায় ৪ হাজার বিদেশি মেহমান ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন এবং অনেকেই এখনো পথে রয়েছেন। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত তাঁরা ময়দানে আসবেন বলে জানিয়েছেন। 

বিশেষ ট্রেন : ইজতেমা উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের দিন ময়মনসিংহ-টঙ্গী, ঢাকা-টঙ্গী ও টাঙ্গাইল টঙ্গী রুটে ১৩টি অতিরিক্ত ট্রেন চলাচল করবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা রাকিবুর রহমান।

মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সা’দ অনুসারীদের পৃথক ব্যবস্থাপনায় এবারের বিশ্ব ইজতেমায় দুটি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার হতে শুরু হওয়া প্রথম ধাপের ইজতেমা রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। প্রথম ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন জোবায়েরপন্থি আলেম ওলামা কওমিপন্থি তাবলিগ অনুসারী মুসল্লিগণ। প্রথম ধাপের আখেরি মোনাজাতের পর চার দিন বিরতি দিয়ে আগামী শুক্রবার (২০ জানুয়ারি)  থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা। দ্বিতীয় ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন সা’দ অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তাবলিগ অনুসারীরা।

স্বাস্থ্যসেবা : টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম জানান, মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য বিভাগ পাঁচটি ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এ হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষে সাতটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ওইসব ক্যাম্প থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও বিন্যামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, জুমার নামাজ আদায় করতে আশপাশের জেলার মুসল্লিরা এখানে আসেন। জুমার নামাজ উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যানজটমুক্তভাবে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ রাখা হয়েছে। ইজতেমার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে পুরো টঙ্গীজুড়ে। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় ছিনতাই-পকেটমারসহ অপরাধ কার্যকলাপ রুখতে টহল টিম রয়েছে। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। র‌্যাবও ইজতেমা ময়দানে ওয়াচ-টাওয়ার সিসি ক্যামেরা ও কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। তিনি বলেন, রবিবার আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। ইজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লি ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মুসল্লি আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ইজতেমা এলাকায় আসেন। সেটির জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে টঙ্গী ব্রিজ, কামারপাড়া ব্রিজ, ভোগড়া বাইপাস, মীরেরবাজার এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে ইজতেমা-সংলগ্ন এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হবে। ইজতেমা শেষে যাওয়ার সময় একই ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকবে। আমরা নাগরিকদের কাছে আশা করব তারা যেন সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখেন। রাস্তায় যে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করবে তাদের সহযোগিতা করবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানান, মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ ট্রেন, পর্যাপ্ত বিআরটিসি বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এজন্য পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্রস্তুত রয়েছেন। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠে মোতায়েন রয়েছেন। তিনি জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চলাচলের জন্য প্রবেশপথে আর্চওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ খাবার ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধানের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন ৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।

কন্ট্রোল রুম : বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের খেদমতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, র‌্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের (ডেসকো) পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর