বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

৪৮ বছর পর অবিশ্বাস্য মিলন বাবা-ছেলের

ছয় মাসের সন্তান রেখে ভারত যান স্বামী পাচারের শিকার স্ত্রী এখন পাকিস্তানে

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

৪৮ বছর পর অবিশ্বাস্য মিলন বাবা-ছেলের

স্ত্রী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে অভিমান করে ৪৮ বছর আগে দেশ ছেড়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন আমজাদ আলী। এরপর  জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে থিতু হন আসামের তেজপুরে। সংসারও পাতেন সেখানে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে চলছে জীবন। কিন্তু ভারতে আবাস গড়লেও মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ফেলে আসা স্ত্রী হাজেরা খাতুন আর ছয় মাসের ছেলে কালা মিয়ার কাছে। কিন্তু দেশান্তরী আমজাদের তখন আর দেশে ফেরার সুযোগ-সামর্থ্য নেই। কেউ খোঁজও দিতে পারেনি স্ত্রী ও ছেলের। আমজাদের বিশ্বাস ছিল একদিন তিনি ঠিকই ফিরে পাবেন হারিয়ে ফেলা স্ত্রী ও ছেলেকে। শেষ পর্যন্ত ৪৮ বছর পর অনেকটা অলৌকিকভাবে ছেলে কালা মিয়াকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। তবে ছেলেকে পেলেও স্ত্রী হাজেরার সঙ্গে দেখা হয়নি। পাচারের শিকার হয়ে তিনি এখন পাকিস্তানে। আমজাদের বিশ্বাস, ছেলের মতো স্ত্রীকেও একদিন তিনি ফিরে পাবেন।

১০১ বছর বয়সী আমজাদ আলীর সঙ্গে দেখা হয় তার ছেলে কালা মিয়ার বাসায়। অটোরিকশাচালক কালা মিয়া থাকেন সিলেট নগরের বাগবাড়ী মদিনা আবাসিক এলাকায়। আমজাদ জানালেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও স্ত্রীর ওপর অভিমান করে ছয় মাসের ছেলেকে রেখে তিনি চলে যান আসামে। আসামের তেজপুরে দিনমজুরের কাজ করতেন। প্রচ- অভিমানী আমজাদের মন স্ত্রী ও ছেলের জন্য কাঁদলেও জেদ ধরে থেকে যান সেখানে। একসময় একই এলাকার তরুণী সমরজান বিবিকে ভালোবেসে ফেলেন। প্রেম গড়ায় পরিণয়ে। প্রায় ১৫ বছর আগে মারা গেছেন সমরজান। তার গর্ভে আমজাদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে।

আমজাদ জানান, ময়মনসিংহে ফেলে যাওয়া স্ত্রী ও ছেলের জন্য তার মন কাঁদত। অনেক রাত কেঁদেকেটে কাটিয়েছেন। কিন্তু তাদের কোনো খবর পাননি। বাংলাদেশের কাউকে পেলে ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সন্ধান চাইতেন। কেউই খোঁজ দিতে পারেনি। স্ত্রী ও সন্তানের খোঁজে গত ৫ জানুয়ারি সিলেটের তামাবিল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন আমজাদ। ময়মনসিংহ গিয়ে খুঁজে পান পুরনো কিছু আত্মীয়স্বজন। তারা সন্ধান দেন ছেলে কালা মিয়ার। ফোনে কথা হয় বাপ-ছেলের। পরিবারের সবাইকে নিয়ে পরদিনই কালা মিয়া ছুটে যান ময়মনসিংহে। নিয়ে আসেন বাবাকে। আমজাদ আলীকে ঘিরে কালা মিয়ার পরিবারে এখন ঈদের খুশি। কালা মিয়া জানান, বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর ভিডিওকলে ভারতে থাকা তার সৎ ভাই-বোনদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা সেখানে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছেন। তাদের দেখতে যাওয়ার জন্য তিনি পাসপোর্ট তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কালা মিয়া জানান, জন্মের ছয় মাস পরই বাবা অভিমান করে চলে যান ভারতে। আট বছর বয়সে পাচারকারী দলের কবলে পড়েন তার মা। ভারত হয়ে মায়ের আশ্রয় হয় পাকিস্তানে। সবকিছুর জন্য তিনি দায়ী করতেন বাবাকে। বাবার প্রতি তার প্রচ- অভিমান ছিল। কিন্তু কাছে পেয়ে বাবার প্রতি সব অভিমান ভুলে গেছেন। এখন রাতে তিনি বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান।

কালা মিয়া জানান, তার বয়স যখন ১৮-২০ বছর, তখন মা হাজেরা খাতুন পাকিস্তান থেকে চিঠি লিখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের করাচি থাকেন তিনি। এরপর আরও কয়েকবার চিঠি এসেছিল। কিন্তু যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন থাকেনি। এখন আর মায়ের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে ৪৮ বছর বয়সে বাবাকে ফিরে পাওয়ায় তিনি আশাবাদী একদিন মাকেও ফিরে পাবেন।

কালা মিয়ার স্ত্রী আকলিমা বেগমও শ্বশুরকে ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি। বাবা-মা হারা আকলিমা মনে করেন আমজাদ আলীই তার বাবা। একদিন শাশুড়ি ফিরে এসে তার মায়ের অভাব পূরণ করে দেবেন, এমন আশায় বুক বেঁধেছেন আকলিমা।

আমজাদের বড় নাতি সুজন মিয়া পেশায় সিএনজি অটোরিকশাচালক। গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে এখন ব্যস্ত দাদার সেবায়। নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে সুজন বলেন, ‘আমার বাবা ছোটবেলায় কাউকে বাবা ডাকতে পারেননি। আমি সেই কষ্টটা অনুধাবন করতে পারছি। এখন আমার বাবা তার বাবাকে খুঁজে পেয়েছেন। এর চেয়ে বড় আনন্দের কিছু নেই। দাদাকে দেখতে পাওয়াটা আমাদের পরিবারের কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য।’ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ৪ ফেব্রুয়ারি ভারত ফিরে যাবেন আমজাদ মিয়া। তবে খুব দ্রুতই তিনি আবারও ফিরবেন ছেলে ও তার পরিবারের কাছে। আর মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো স্ত্রী হাজেরাকে দেখে মান ভাঙতে চান তিনি- এটাই এখন তাঁর শেষ চাওয়া।

সর্বশেষ খবর