সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
সীতাকুন্ডে বিস্ফোরণ

এখনো আতঙ্ক, ক্ষতি শত কোটি টাকা

মুহাম্মদ সেলিম, সোনাইছড়ি (সীতাকুন্ড) থেকে ফিরে

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়ন। ঠিক ৯ মাস আগে গত বছর ৪ জুন বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বিএম ডিপো। সেই ক্ষত শুকানোর আগেই মাত্র আধা কিলোমিটারের মধ্যে ‘সীমা অক্সিজেন লিমিটেড’ নামের একটি অক্সিজেন উৎপাদনকারী কারখানায় বিস্ফোরণে ফের কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের ফলে এক বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উড়ে গেছে আশপাশের কল-কারখানা ও বসতবাড়ির ছাদ। ভেঙে গেছে দরজা-জানালা। ফাটল দেখা দিয়েছে দেয়ালে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে নষ্ট হয়ে গেছে হাজার হাজার টিভি, ফ্রিসহ ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম। বিস্ফোরণের পর থেকে পুরো এলাকা হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎহীন। সব মিলিয়ে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি এলাকা। কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হতে না পারলেও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার সত্যতা মিলেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। গতকাল বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি। পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বাতাস পৃথককরণ প্লান্ট থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়েছে। এরই মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ আলামতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডার পাওয়া গেছে, যেগুলো রাখার অনুমোদন ছিল না। এ ঘটনায় কার কার গাফিলতি আছে তা খতিয়ে দেখা হবে। এরই মধ্যে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কারখানার ধ্বংসস্তূপ সরাতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে।’ চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণ এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কি না তাও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’ চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদফতরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার পর বিস্ফোরণের কারণ বলতে পারব।’ জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ও সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘তদন্ত টিম এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারব।’ সরেজমিন দেখা যায়, বিস্ফোরণের পর ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেলেও সোনাইছড়ির পুরো ইউনিয়নের লোকজনের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। স্থানীয় বাসিন্দারা এখনো বিস্ফোরণ ট্রামায় ভুগছেন। বিস্ফোরণের বিকট শব্দের কারণে অনেকে এখনো কানে শুনতে পাচ্ছেন না। অনেকের মধ্যে আবার শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। গতকাল সকালে উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সমাপ্ত করা হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। কারখানার শ্রমিকরা তা স্তূপ করে রাখছেন। লন্ড ভণ্ড অবস্থায় পড়ে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি গাড়ি। বিস্ফোরণের ফলে সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানার অক্সিজেন উৎপাদন শেড পুরোটাই উড়ে গেছে। কারখানার মধ্যে থাকা দুটি ভবন পুরোটাই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সীমা অক্সিজেনের আশপাশে থাকা ছোট-বড় আরও কমপক্ষে ২০টি কারখানার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিস্ফোরণে এসব কারখানার কোনো কোনোটির ছাদ উড়ে গেছে। ভেঙে গেছে ভবনের দেয়াল। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের এখনো কোনো কারণ জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদফতরসহ তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ আশপাশের বসতিতেও চালিয়েছে ভয়াবহ তান্ডবলীলা। প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকার আবাসিক ভবনের কোনোটারই জানালার গ্লাস অবশিষ্ট নেই। ফাটল দেখা দিয়েছে ভবনের দেয়ালে। বিস্ফোরণের পর নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার পরিবারের ফ্রিজ, টেলিভিশন, ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। ঘটনার কিছুক্ষণ পর থেকে থেকেই বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এলাকা। বিস্ফোরণের ফলে সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।

সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের ম্যানেজার আবদুল আলিম বলেন, ‘কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে এটা বলতে পারি, কারখানার অগ্নিনির্বাপণ গাইড অনুসরণ করা হতো। এ ঘটনার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আমরা প্রশাসনকে সহযোগিতা করব। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে সার্বিক সহায়তা করব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারখানার কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা ধারণা করছি এ বিস্ফোরণের কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষের কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’ ঘটনাস্থলের পাশের দোকানদার আইয়ুব আলী বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর প্রায় ৩০ মিনিট অন্ধকার ছিল পুরো এলাকা। দোকানের টিভি, ফ্রিজ, ফ্যানসহ সব ইলেকট্রনিক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু আমার নয়, পুরো এলাকার একই অবস্থা। এ ছাড়া এখন কানে আগের মতো শুনছি না।’ একই এলাকায় থাকা তিনটি ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজী মুন্সি মিয়ার। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর মনে হয়েছে কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। আধঘণ্টা কোনো কিছুই দেখিনি। পুরো এলাকা ছিল অন্ধকারে। ওই বিস্ফোরণে কারখানার আশপাশে থাকা আমার মালিকানাধীন দুটি বহুতল ভবন এবং একটি টিনশেডের ঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহুতল ভবনের দরজা-জানালা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। টিনের তৈরির ভাড়ার ঘরের ছাদ উপড়ে গেছে। পুরো এলাকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

মামলা করবে পুলিশ : সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। ফায়ার সার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান শেষ করলে মামলাটি রেকর্ড করা হবে। সীতাকুন্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিস্ফোরণের পর প্রাথমিকভাবে তদন্ত চলছে। প্রাথমিক তদন্তে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস অভিযান শেষ করলে হতাহতদের নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।

সর্বশেষ খবর