বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঘরে ফেরা হয়নি তাদের

সাখাওয়াত কাওসার

ঘরে ফেরা হয়নি তাদের। কেউ স্যানিটারি সামগ্রী কিনতে গিয়ে লাশ হয়েছেন, কেউবা জীবিকার প্রয়োজনে কর্মস্থলে গিয়ে। তাদের কেউ সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ঘরেও উঠিয়ে নিতে পারেননি, কর্মস্থলেই নিজেদের শেষ পদচিহ্ন এঁকেছেন। হতভাগা এসব মানুষের স্বজনদের অনেকেই জানেন না এই পৃথিবীর মায়াকে পাশ কাটিয়েছেন তারা। পাড়ি জমিয়েছেন অজানার ঠিকানায়। আবার অনেকের স্বজনরা এখনো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা বিশ্বাস করেন, স্বজনরা ঠিকই ঘরে ফিরবেন। অন্যদিকে লাশ হয়ে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গের পরিবেশ। তাদের আহাজারিতে চোখ ভিজে উঠছে নানা কারণে ঢামেকে অবস্থানরত অন্যদেরও। জানা গেছে, মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে করেছিলেন আর্নিকা গ্যালারির কর্মচারী রবিন হোসেন (১৯)। তবে এখনো স্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেওয়া হয়নি। রবিনের পরিকল্পনা ছিল, অনুষ্ঠানসহ সংসার সাজাতে কিছু টাকা গোছানো প্রয়োজন। এর পরই স্ত্রীকে বাড়িতে তুলে আনবেন। তবে কর্মস্থলেই অন্য অনেকের মতো পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে এখনো শুকায়নি মেহেদির রং। গতকাল বেলা সাড়ে ৪টার দিকে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের নিচতলা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকারী দল। কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সামনে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ছোটভাই রবিনের প্রতীক্ষায় ছিলেন শাহাদত হোসেন। বলছিলেন, ‘বাবা-মা রবিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সে বাড়ি গেলেই খেতে বসবেন তারা। একটু পর পর ফোন দিচ্ছেন। রবিনের খবর জানতে চাইছেন।’ সোহরাব হোসেন ও শাহিন বেগম দম্পতির সবার ছোট সন্তান রবিন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন পুরান ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকার মুরাদপুরে। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া। মঙ্গলবার বিকালের বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকেই ভবনটির সামনে ভাইয়ের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন বড় ভাই শাহাদাত হোসেন। বলছিলেন, ‘আমার বাবা-মা রবিনের জন্য পাগলপ্রায়। সবার ছোট সন্তান হওয়ায় তার প্রতি তাদের মায়াও একটু বেশি।’ ফোনে রিং বাজছিল আর্নিকা গ্যালারির মালিক মহিউদ্দীন সুমনের (০১৮১৯২১৩৪৯১)। সচল ছিল ফোনের ইন্টারনেট সংযোগও। তবে রিসিভ হচ্ছিল না। স্বজনদের প্রত্যাশা ছিল, হয়তো কোনো এক সময় ফোন রিসিভ করবেন সুমন। জানাবেন, কোথায় আছেন কেমন আছেন। ২৫ মালিটোলার বাসায় সুমনের চিন্তায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন স্ত্রী শারমিন আক্তার। ঘটনার পর থেকে তিনি বারবার স্বামীর ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল খুদে বার্তা। কেউ রিসিভ কিংবা রিপ্লাই না করলেও শারমিনের ভাবনায় ছিল, হঠাৎ করেই তার স্বামী ফোন রিসিভ করবেন। হয়তোবা খেপে গিয়ে বলবেন, ‘এত ফোন দিচ্ছ কেন? জানো না খুব ব্যস্ত আছি!! একটু পরে ফোন দিচ্ছি।’ কুইন স্যানিটারি মার্কেটের বেজমেন্ট থেকে লাশ উদ্ধারের আগ পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন তার স্বজনরা। তাদেরই একজন সুমনের খালাতো ভাই ইব্রাহীম রাশেদ। তিনি বলেন, সুমন ও তার এক কর্মচারীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার (সুমনের) দুটি ফোনের মধ্যে একটি মঙ্গলবার রাতেই উদ্ধার হয়েছিল। সেটি এর পর থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে। ইসলামবাগ থেকে নিজেদের বাড়ির কাজের জন্য স্যানিটারি পণ্য কিনতে গিয়েছিলেন মমিনুল ইসলাম ও নদী বেগম দম্পতি। কুইন স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণের সময় সেখানেই ছিল তাদের অবস্থান। পণ্য কিনে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। দুজনের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠান উদ্ধারকারীরা। মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালের এ-ঘর ও-ঘর দৌড়াদৌড়ি করছিলেন নিহত দম্পতির স্বজন আবদুর রহিম। তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘দুপুরে স্যানিটারি মালামাল কিনতে আসে তারা। বিস্ফোরণের সময় ঘটনাস্থলেই মারা যায় নদী। তার লাশ মেডিকেলে আছে খবর পেয়ে এখানে আসি। নদী আমার ভাস্তে বউ। তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই খবর পাই ভাস্তে মমিনুলের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। এখন আমরা লাশ বুঝে নেওয়ার কাজ করছি।’ মমিনুল ঢাকায় সিসি ক্যামেরা ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। মুন্সীগঞ্জের আবু জাফর সিদ্দিকের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল। এ জন্য তার পরিবার বাড়ি নির্মাণে হাত দেয়। গজারিয়া উপজেলার বালিয়াকান্দি পশ্চিমপাড়ায় সেই নির্মাণাধীন বাড়ির জন্য স্যানিটারি সামগ্রী কিনতে সিদ্দিকবাজারের কুইন মার্কেটে গিয়েছিলেন মঙ্গলবার। সঙ্গে ছিলেন চাচাতো ভাই আলাদ হোসেন। কেনাকাটা শেষে বিকালে ক্যাফে কুইন রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। এ সময় ওই মার্কেটে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই জাফরের মৃত্যু হয়। এদিকে আলাদ হোসেনের শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বর্তমানে আলাদ হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। মাঈন উদ্দিন কুইন মার্কেটের আজাদ স্যানিটারি নামের একটি দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে স্ত্রী পারভিন বেগমের সঙ্গে সর্বশেষ বলেছিলেন, ‘সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়িতে চলে আসব। বাড়িতেই শবেবরাতের নামাজ পড়ব।’ পারভিনের স্বামী বাড়ি ফিরেছেন। তবে লাশ হয়ে। পারভিন বেগমের বড় বোন আসমা বেগম বলেন, মাহমুদুল হাসান (২২) ও আবিদ হাসান (১২) নামের মাঈন উদ্দিনের দুই ছেলে রয়েছে। একসময় ওই মার্কেটেই তার দোকান ছিল। তবে ব্যবসায় লোকসানের কারণে দোকান ছেড়ে দেন তিনি। দুই বছর ধরে ওই মার্কেটের আজাদ স্যানিটারি নামের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছিলেন মাঈন উদ্দিন।

ঘরে না ফেরাদের মধ্যে ছিলেন ভ্যানচালক ইদ্রিসও। কুইন মার্কেটের ঠিক সামনেই আরেক ভ্যানচালক রহমতের সঙ্গে গল্প করছিলেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই তারা এখানেই ভাগ্যের অন্বেষণে আসেন। কাজের ফাঁকে ১৮০/১ কুইন মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটের সামনে গল্প করে সময় পার করেন। কাস্টমার খোঁজেন এখান থেকেই। এ সময় পাশের এক খেজুর ব্যবসায়ী আসরের নামাজে যাচ্ছিলেন। এ জন্য রহমতকে ডেকে তার দোকানের দিকে একটু নজর দিতে বলছিলেন। এর এক-দুই মিনিটের মধ্যেই ঘটে সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ইদ্রিস। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তারই সহকর্মী রহমত এবং সেই খেজুর ব্যবসায়ী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর