জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন যখন শেষ পর্যায়ে ভুটানের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। দেশটির অর্থনীতির প্রতিটি খাতে কার্বন প্রশমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং গ্রিন হাইড্রোজেনের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি।
জলবায়ু সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পশ্চিমা ধনী দেশগুলো। যদি এসব দেশ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে তাদের নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও সুখ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। এমনটাই মনে করেন বিশ্বের প্রথম কার্বন-নেগেটিভ দেশ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে।
পূর্ব হিমালয়ের কোলে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ ভুটান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম উন্নত জলবায়ু্র দেশ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তোবগে বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক এবং জিডিপির চেয়ে মোট জাতীয় সুখ বা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার কারণেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।
তোবগে বলেন, সীমিত সম্পদ আর বিশাল ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা জলবায়ু কার্যক্রম, সামাজিক অগ্রগতি, সংস্কৃতি রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে পেরেছি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রে রয়েছে জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ এবং ভালো থাকা।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি এটি করতে পারি, তবে উন্নত ধনী দেশগুলোর—যাদের সম্পদ ও রাজস্ব অনেক বেশি—অবশ্যই কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আরও অনেক বেশি কিছু করা উচিত।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভুটানের অবদান নগণ্য। দেশটির ৭২ শতাংশ এলাকা বনাঞ্চল, যা কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের মতে, প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যের সঙ্গে পুরোপুরি বা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা নেওয়া হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে ভুটান অন্যতম।
ভুটানের এই পরিবেশপ্রেম কেবল জাতিসংঘের জলবায়ু প্রক্রিয়ার অংশ নয়, এর শেকড় আরও গভীরে। ভুটানিরা বিশ্বাস করেন, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে তাদের দেবতারা বাস করেন। এ কারণেই দেশটির বন এবং নির্দিষ্ট কিছু জলাশয়ে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি পর্বতারোহণও সেখানে নিষিদ্ধ। বিশ্বের সর্বোচ্চ আরোহণ না করা পর্বত 'গাংখার পুয়েনসাম' (উচ্চতা ৭,৫০০ মিটারের বেশি) ভুটানেই অবস্থিত।
দেশটির সংবিধানের একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ পরিবেশ রক্ষার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে, যেখানে দেশের অন্তত ৬০ শতাংশ এলাকা সবসময় বনাচ্ছাদিত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ও প্রতিটি নাগরিকের জন্য পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সব ধরনের পরিবেশগত অবক্ষয় রোধ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তোবগে বলেন, আমরা যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করি, তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি শোষণ করছি। আমরা জীববৈচিত্র্য ও বনের যত্ন নিচ্ছি। আমরা 'নেচার পজিটিভ' এবং 'কার্বন নেগেটিভ' একটি দেশ। তবুও স্থলবেষ্টিত পাহাড়ি দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব আমাদেরই পোহাতে হচ্ছে।
তোবগে বলেন, 'উন্নত বিশ্বকে তাদের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব পালন করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন এবং নিঃসরণ কমাতে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো, তাদের নিজেদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। ভুটানের মতো ছোট দেশগুলো তাদের সাধ্যের চেয়েও বেশি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ, এমনকি ধনী দেশগুলোর জন্যও।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান
বিডি প্রতিদিন/কেএ