শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

গাজীপুরে ভোটে নাটকীয়তা

মনোনয়নপত্র জমার পর আজমত বললেন, কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না, জাহাঙ্গীরের অভিযোগ হয়তো আমার পায়ে শিকল পরাতে পারে

খায়রুল ইসলাম, গাজীপুর ও আফজাল, টঙ্গী

গাজীপুরে ভোটে নাটকীয়তা

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটে শুরু হয়েছে নাটকীয়তা। ইভিএমের মাধ্যমে আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাময়িক বরখাস্ত মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। একই পদে তার মা জায়েদা খাতুনও দাখিল করেছেন মনোনয়নপত্র। অপরদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা গতকাল মনোনয়নপত্র জমার পর বলেন, কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। জাহাঙ্গীরের অভিযোগ হয়তো আমার পায়ে শিকল পরাতে পারে। মনোনয়নপত্র জমা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আজমত আরও বলেন, আমরা সবাই আওয়ামী লীগ পরিবার। যারা প্রকৃত আওয়ামী লীগ, তারা সবাই আমার সঙ্গে আছেন। এখানে জাহাঙ্গীর নিয়ে কোনো চাপ ফিল করার কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলাম। এই ১৮ বছরে আমার বিরুদ্ধে একটা দুর্নীতির রেকর্ড নেই। তাই জনগণও এমন কাউকে চাইবেন, যিনি দুর্নীতিমুক্ত। সেই দিক থেকে জনগণ আমার পাশে আছেন। তাঁরা আমাকেই ভোট দেবেন।’ মনোনয়নপত্র জমা শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্বাচন আইনে যেভাবে নির্বাচন করতে হয়, গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে যেভাবে নির্বাচন করতে হয়, সেই পদ্ধতিতে আমি একজন নাগরিক হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ওপর যে নির্যাতন ও মিথ্যাচার করা হয়েছে, তার জন্য আমার মা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। আমার মা যা চাইবেন আমি তাই করব। আমি জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ করি, করব। আমার মায়ের হুকুমেই তার মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছি। আমার মা আমাকে এই শহর রক্ষার কথা বলেছেন, আমি এ জন্য এসেছি।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল গতকাল। শেষ দিনে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। মেয়র পদে ১২ জন ছাড়াও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৯০ এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৮২ প্রার্থীসহ ৩৮৪ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করা অন্য প্রার্থীরা হলেন- জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, জাকের পার্টির মো. রাজু আহম্মেদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন, সরকার শাহনুর ইসলাম রনি, মো. হারুন অর রশীদ, মোহাম্মদ অলিউর রহমান, মো. আবুল হোসেন।

মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষদিন গতকাল দুপুরে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে স্থাপিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলামের কাছে তার মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিকালে জিসিসির সাময়িক বরখাস্ত মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা জায়েদা খাতুনের মেয়র পদের মনোনয়নপত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জমা দেওয়া হয়। এর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহ নুর ইসলাম তার মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেন। এ ছাড়া এদিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান, জাকের পার্টির প্রার্থী মো. রাজু আহম্মেদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ অলিউর রহমান, মো. আবুল হোসেন তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর আগে বুধবার জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন, গণফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল ও মো. হারুন অর রশীদ তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম রনি। রনি কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক যুব ও শিল্প বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে। রনির বাবা নুরুল ইসলাম সরকার বর্তমানে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় জেল খাটছেন।

রনি মনোনয়নপত্র জমা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আমি যেহেতু বিএনপি পরিবারের সন্তান। আমার চাচা, বাবা সবাই বিএনপি করেন। আমি ইতোমধ্যে একাধিক উঠোন বৈঠক করেছি। তৃণমূল কর্মীদের সমর্থন পেয়েছি। যার কারণে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব। তিনি আরও বলেন, আমার চাচা এই গাজীপুরে ৩০০’র বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন। আমার বাবা আজ ১৮ বছর ধরে কারাগারে বন্দি। বাবা, চাচার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পরিবারের সদস্যদের ও সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। তিনি বলেন, বিএনপিতে আমার কোনো পদ-পদবি ছিল না বা নেই। আমি আশা করছি শুধু বিএনপির নয় দলমত নির্বিশেষে সবাই আমাকে ভোট দেবেন।’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মেয়র প্রার্থী মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আশা করি সরকারের কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবে। জেলা নির্বাচন অফিসার ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার এএইচএম কামরুল হাসান জানান, সবশেষ মেয়র পদে ১২ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৯০ এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৮২ জন প্রার্থীসহ ৩৮৪ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এর আগে বুধবার পর্যন্ত মেয়র পদে ১৩ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৪৩ এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৮৯ জন প্রার্থীসহ ৪৪৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র উত্তোলন ও জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল ২৭ এপ্রিল। ৩০ এপ্রিল মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৮ মে এবং প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ মে। ইভিএমের মাধ্যমে ২৫ মে অনুষ্ঠিত হবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

আজমতের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ : গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের মহড়া বা প্রার্থীর সঙ্গে পাঁচজনের বেশি লোক না রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে সেই নির্দেশনা না মানার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তবে আজমত উল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আচরণবিধি ঠিক রেখেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। আমার সঙ্গে পাঁচজনের বেশি লোক ছিলেন না।

দুই প্রার্থীকে শোকজ : আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে এক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এবং একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। শোকজপ্রাপ্তরা হলেন, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল এবং নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সনজিৎ মল্লিক। বুধবার তাদের ওই কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম সই করা চিঠিতে বলা হয়, গাজীপুর সিটি নির্বাচন উপলক্ষে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশন সচিবালয়সহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পোস্টার অপসারণের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে মাইকিং করা হয়। তারপরও সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছবিসম্বলিত পোস্টার বিভিন্ন দেওয়ালে লাগানো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়া নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ওয়ার্ডের বাউন্ডারি দেওয়ালে কাউন্সিলর প্রার্থী সনজিৎ মল্লিকের পোস্টার শোভা পাচ্ছে, যা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল, অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না।

ওই বিধিমালার বিধি ৩১ অনুসারে কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং বিধি ৩২ অনুসারে প্রার্থিতা বাতিলেরও বিধান আছে।

আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত সব পোস্টার, বিলবোর্ড নিজ খরচে অপসারণসহ ওই বিধিমালার অধীনে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কারণ দর্শানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আইন ও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর