সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

গ্যারান্টারের সম্পত্তিও নিলামে উঠবে

► ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ► আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক রায়ে খেলাপি ঋণ আদায় গতি পাবে ► অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার মামলা পেন্ডিং ► আটকে আছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা

শাহেদ আলী ইরশাদ

গ্যারান্টারের সম্পত্তিও নিলামে উঠবে

কোনো গ্রাহক ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে পাওনা সমন্বয় করতে পারবে ব্যাংক। অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী কোনো গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করতে কোনো বাধা নেই। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

ব্যাংকাররা মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক রায়ে কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলামে তোলার পথ পরিষ্কার হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় এখন গতি পাবে। এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের অনেক মামলা ঝুলে আছে। মাননীয় বিচারক যে রায় দিয়েছেন সেটি মাইলফলক। আমাদের জন্য ভালো। খেলাপি ঋণ আদায়ে তা আমাদের অনেক সাহায্য করবে।’

ঘটনার সূত্রপাত অগ্রণী ব্যাংকের গাজীপুরের একটি শাখার একটি ঋণ নিয়ে। মেশিনারিজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ কে আলী ট্রেডার্সের মালিক আলী রেজা শাওন ২০০৮ সালে ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সম্পত্তি বন্ধক রাখার পাশাপাশি সেই ঋণের গ্যারান্টার করেছিলেন তার বন্ধু ব্যবসায়ী দেওয়ান মুরাদ হোসেনকে। ২০১১ সালে ঋণটি খেলাপি হয়। তখন এ কে আলী ট্রেডার্সের কাছে সুদ-আসলে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ১৯ কোটি টাকা। পাওনা আদায়ে গাজীপুর অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে অগ্রণী ব্যাংক। আলী রেজা শাওনের পাশাপাশি আসামি করা হয় গ্যারান্টার দেওয়ান মুরাদ হোসেনকেও। ২০১৫ সালে আদালত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আলী রেজা শাওনের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে পাওনা আদায়ের নির্দেশ দেন। পরে শাওনের সম্পত্তির নিলাম ডাকে ব্যাংক। কোনো ক্রেতা বা প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ না নেওয়ায় ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তি দখলে নেয় ব্যাংক। সেই সম্পত্তির যে মূল্য তাতে ব্যাংকের পাওনা টাকার অর্ধেক উঠে আসে। বাকি অর্থ আদায়ে গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলামের নির্দেশনা চেয়ে আবারও আদালতে আবেদন করে ব্যাংক। আদালত গ্যারান্টারের সম্পত্তি একটি অটো রাইস মিল ও একটি রেস্টহাউস বিক্রি করে বাকি পাওনা টাকা আদায়ের নির্দেশ দেন। ওই নিলাম আদেশ স্থগিত করার জন্য গ্যারান্টার হাই কোর্টে রিট করেন। ২০১৫ সালে হাই কোর্ট নিলাম কার্যক্রমের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। ব্যাংক হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করলে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত হাই কোর্টের আদেশ বহাল রাখেন এবং আপিলটি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে সেই আপিল নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশ বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী কোনো গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলামে তুলে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করতে কোনো বাধা নেই। রায়ে বলা হয়, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ৬(৫) ধারার ক্ষমতাবলে মূল ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওই ঋণের গ্যারান্টারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। এতে বলা হয়, আদালতের দেওয়া রায়, আদেশ বা ডিক্রি সব বিবাদীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে ও পৃথকভাবে কার্যকর হবে। ডিক্রি জারির মাধ্যমে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল খেলাপির সম্পত্তি এবং তারপর যতটা সম্ভব গ্যারান্টারের সম্পত্তি সংযুক্ত করবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গ্যারান্টার যদি বাদীর পক্ষে ডিক্রির দাবি পরিশোধ করেন, তবে উল্লিখিত ডিক্রি যথাক্রমে তাদের অনুকূলে স্থানান্তর করা হবে এবং তারা খেলাপির বিরুদ্ধে সেটি প্রয়োগ করতে পারবেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। আপিল বিভাগ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, এ রকম বিষয়ে অনেক সময় হাই কোর্টকে ভুল বুঝিয়ে গ্যারান্টার বা ঋণখেলাপিরা নিজেদের পক্ষে আদেশ নেন। আর হাই কোর্ট অনেক সময় আইনের ‘মূল স্পিরিট’ বুঝতে ব্যর্থ হন। এ রকম বিষয়ে রিট হলে হাই কোর্টকে সাবধানতার সঙ্গে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন থেকে সহজে কেউ ঋণের গ্যারান্টার হতে রাজি হবে না। আর যখন গ্যারান্টার পাওয়া যাবে না, তখন ঋণ নেওয়ার সময় ঋণগ্রহীতারা বেশ সতর্ক হবে। নিলাম ঠেকাতে গ্যারান্টারদের যেসব রিট এখনো হাই কোর্টে পেন্ডিং আছে, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সেগুলো খারিজ হবে। এখন থেকে ঋণখেলাপিরা আদালতের স্থগিতাদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদসহ পুরো ঋণ পরিশোধের দায় এড়াতে পারবেন না। আপিল বিভাগের এই ঐতিহাসিক রায়ে টাকা আদায়ের সেই পথ সুগম হলো।

ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই জামিনদার বা গ্যারান্টার হয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্যারান্টি দিয়ে থাকে।

ঋণখেলাপি হলে গ্যারান্টারের ওপরও দায় বর্তায় ঋণ পরিশোধের জন্য। আর সে জন্যই ঋণ না নেওয়া সত্ত্বেও গ্যারান্টররাও ঋণখেলাপি হন বলে জানান ইমরান। ‘আর তাই ঋণখেলাপি হলে ঋণ আদায়ের জন্য কেবল ঋণগ্রহীতা নয়, গ্যারান্টারের বিরুদ্ধেও মামলা করার বিধান রয়েছে বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত আইনে’- বলেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার গ্যারান্টারের সম্পত্তি নিলাম করে ব্যাংক টাকা আদায় করতে পারবে এটা আইনেই আছে। অর্থ ঋণ আদালতে এ ধরনের পেন্ডিং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকের নিজস্ব আইনজীবীদের উদ্যোগ নিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করার বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজার ৬৪১টি রিট দায়ের করেছেন গ্যারান্টাররা। এসব রিটের ৮০ শতাংশ আদেশ গেছে রিটকারীদের পক্ষে। ফলে আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২ সালে দায়ের করা ৩ হাজার ১৪৪টি রিট আবেদনে আটকে আছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে ২ হাজার ৮৬২টি রিট আবেদন দায়ের হয়েছে। এসব আবেদনে আটকা ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। ২০২০ সালে আবেদন ছিল ২ হাজার ১১৩টি, আটকা ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ না করতে ২০১৯ সালে গ্যারান্টাররা ২ হাজার ৯৭৬টি রিট আবেদন দায়ের করেছে। ২০১৮ সালে ছিল ২ হাজার ৫৪৬টি, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

দেশের বিভিন্ন অর্থঋণ আদালতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়ের করা ৭২ হাজার মামলা পেন্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার কোটি টাকার ২৬ হাজার মামলা রয়েছে ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতে। এসব মামলায় গ্যারান্টার বিবাদী হিসেবে রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার ব্যক্তি।

সর্বশেষ খবর