শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

খরচের চাপে দিশাহারা

বাজার করতেই পকেট ফাঁকা ♦ চাল আটা চিনি তেল পিঁয়াজ মাছ মাংস সবজি চড়া দাম ♦ ডিমের ডজন আবারও ১৫০ টাকা ♦ নেই মনিটরিং

মানিক মুনতাসির

খরচের চাপে দিশাহারা

বেসরকারি স্কুল শিক্ষক মুুহিবুল হাসানের সঙ্গে দেখা খিলগাঁও বাজারে। বললেন, মাসের শুরুতে বাড়ি ভাড়ার পেরেশানির সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে প্রাত্যহিক বাজার। একটা সময় ছিল ৫০০ বা ১ হাজার টাকায় ব্যাগ ভর্তি শাক, সবজি দু-এক পদের মাছের সঙ্গে চাল, ডালও কেনা যেত। এখন তো ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। ডিমের ডজনও ১৪৫-১৫০ টাকা। কই, পাঙাশ, তেলাপিয়াও ছোঁয়া যায় না। এসব মাছও এখন ২২০-২৫০ টাকা কেজি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে। বেতনের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল। দুটোই বেড়েছে। তিনি বলেন, এরপর দুই সন্তানের স্কুলের বেতন গত বছর ছিল ৫ হাজার। এখন সেটা ৭ হাজার। ছয় মাস আগে বাবা-মায়ের ওষুধের জন্য রাখতেন ৩ হাজার টাকা, এখন সেটা ৫ হাজার টাকা। যাতায়াত খরচের জন্য আলাদা  রেখে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। যা আগে ৩ হাজার টাকায় চলে যেত। খাওয়া বাবদ যেখানে ৬-৭ হাজার টাকায় ভালোভাবে চলা যেত সেখানে এখন ১০-১২ হাজার টাকায়ও চলা যায় না। সঞ্চয় বলতে কিছুই করতে পারি না। এখন তো আর ঋণ করারও জায়গা নেই। এ ছাড়া ঋণ করলে তা শোধ করব কীভাবে? যার ফলে রিকশায় ওঠা ছেড়ে দিয়েছি। একই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। তাও জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

ব্যবসায়ী জাহিদ আহমেদ ‘রেস’ নামক একটি ফ্যাশন হাউসের মালিক। তিনি বলেন, আগের চেয়ে সব ধরনের বিল বেড়েছে। দোকান ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মানুষ আবার কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। এবারের রোজার ঈদে আগের বছরের তুলনায় অন্তত ২ লাখ টাকা কম বিক্রি হয়েছে। লাভের পরিমাণও কমে গেছে। অথচ দৈনন্দিন খরচ যে হারে বেড়েছে তাতে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁর দোকানের আমীন নামের এক কর্মচারী বলেন, এক বছর আগে একটা ডিপিএস ছিল। নতুন বছরে সেটা ভেঙে করোনা মহামারির ঋণ পরিশোধ করেছেন। এখন আর কোনো সঞ্চয় নেই। আগের মাসে তিন-চার দিন মাছ-মুরগি খেতেন এখন সেটা দুই দিনে নামিয়ে এনেছেন। কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংস কেনার মতো সামর্থ্যই হয় না। আগে বাচ্চাদের ডিম খাওয়াতেন মাঝেমধ্যে এখন সেটা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন।

রাজধানীতে অনেক পরিবার রয়েছে- স্বামী-স্ত্রী মিলে আয় করেও কুলাতে পারছেন না। জীবনযাপনের খরচ মিটাতে কোনো হিসাবই যেন মিলাতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে না পারায় মূল্যস্ফীতির চাপ চলে গেছে ১২ বছরের সর্বোচ্চ স্তরে। মে-২০২৩ শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রোজার ঈদের পর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই চিনির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। পিঁয়াজের কেজি তো আচমকা ১০০ টাকায় উঠেছে। আমদানির খবরে পাইকারি বাজারগুলোতে কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এখনো প্রভাব পড়েনি। চাল, আটা, চিনি, তেল, পিঁয়াজ, মাছ-মাংস-সবজি নাগালের ভিতরে নেই কোনোটাই। নিত্যপণ্যের বাজারে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছেই। ডিমের ডজন আবারও ১৫০ টাকা। বাজারে নেই কোনো মনিটরিংও।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষ চরম এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অবশ্য সারাবিশ্বই এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তবে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থায় তেমন কোনো মনিটরিংই নেই বলে তিনি মনে করেন।

এটাই চরম বাস্তবতা যে, করোনা মহামারির চেয়েও বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি অস্বস্তিকর। তখন সাধারণ মানুষের যতটা না ভোগান্তি হয়েছে তারচেয়েও বেশি ভোগান্তিতে রয়েছে এখন। সে সময় দ্রব্যমূল্য খুব একটা বাড়েনি। অথচ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে চাল, আটা, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, ডাল, মসলা সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। এ ছাড়া পণ্যমূল্য বাজারে নেই তেমন কোনো তদারকি। ফলে কারণে অকারণে দাম বাড়াতে তৎপর সিন্ডিকেট। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের মূল্য। এতে বিদ্যুৎ, শিল্পসহ উৎপাদন খাতের খরচ বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশিও বেড়েছে। যেমন গত বছরের এই দিনে দুই কেজি আটার (প্যাকেট) দাম ছিল ৬৫-৭৫ টাকা। গতকাল সেটা বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৫০ টাকা। কাপড় ধোয়ার গুঁড়া সাবানের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এদিকে শাক-সবজিসহ সব ধরনের তরিতরকারি ও জিনিসপত্রের দাম এখনো বাড়তিই রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্যপণ্য, গুঁড়া ও বার সাবানসহ প্রসাধনীর দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ওষধুপত্রের বাজারেও এমন কোনো আইটেম নেই যার দাম বাড়েনি। মাত্র কয়েকদিন পরই কোরবানির ঈদ। এই ঈদে এমনিতেই পিঁয়াজ ও মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে এই মৌসুমে প্রতি বছর মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বাড়ে। তবে এ বছর বেড়েছে আরও আগেই। বিশেষকরা বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বা বাড়াতে এখন আর কোনো মৌসুম বা উপলক্ষের প্রয়োজন হয় না। টিসিবির হিসাবে মসুরের ডলারের দামও বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অথচ এ সময়ের মধ্যে মানুষের আয় বাড়েনি ১ টাকাও। বরং অনেকের আয় উল্টো কমে গেছে। অনেকেই করোনা মহামারির সময় হারানো কাজ এখনো ফিরে পাননি। এতে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে মানুষকে রীতিমতো নাক ও চোখের পানি এক করতে হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর