এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ এবং পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শরাফাতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইসলামী ব্যাংক আর পদ্মা ব্যাংক দখলে নিয়ে লুটের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা ব্যাংক দখল ছাড়াও শেয়ারবাজার থেকে নানাভাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সরানোর অভিযোগও আছে চৌধুরী নাফিজ শরাফাতের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গতকাল আয়কর বিভাগের রাজধানীর কর অঞ্চল-১৫ থেকে দেশের তফসিলভুক্ত ৯১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন অনিয়মে ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ইয়াছির আরাফাতের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে চৌধুরী নাফিজ শরাফাতের পদ্মা ব্যাংক দখল এবং শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সরানোর অভিযোগ অনুসন্ধানে আরেক উপ-পরিচালক ইসমাঈল হোসেনের নেতৃত্বে টিম গঠন করা হয়েছে। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম আগেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু চার-চারবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এক সপ্তাহ আগে এ অনুসন্ধানে নতুন গতি পেয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, তারা জানতে পেরেছেন যে- এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি। গত ১০ বছরে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য আরও সম্পদ কিনেছেন। ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন নিজেদের সাইপ্রাসের নাগরিক এবং সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা দেখিয়ে সিঙ্গাপুরে ক্যানালি লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।
২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর এস আলম তার সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানে ‘ক্যাসিনো কিংপিন’ শাহেদুল হককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। শাহেদুল তখন এস আলম গ্রুপের আংশিক মালিকানাধীন ঢাকার ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ২০১৯ সালে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযানে দুদক ক্যাসিনো ব্যবহার করে অর্থ পাচারে জড়িতদের মধ্যে শাহেদুলকে শনাক্ত করে। পরবর্তীতে তার নামের সঙ্গে ‘ক্যাসিনো’ উপাধিটি জড়িয়ে হয় ‘ক্যাসিনো শাহেদুল’।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, শাহেদুল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন এবং মামলার পর তাকে আদালত সাজাও দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো আদালতে হাজির হননি। আর ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। যার নেপথ্যে এস আলম গ্রুপের নাম এসেছে। এর আগে ২০২২ সালে গণমাধ্যমে এস আলমের একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর হাই কোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) ঋণ কেলেঙ্কারি তদন্তের নির্দেশ দেন। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে চৌধুরী নাফিজ শরাফাত ছিলেন অন্যতম। সূত্র জানায়, লোকসানে ডুবে থাকা পদ্মা ব্যাংকের নাম ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে ছিল ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি চালুর পর থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, সাবেক আমলা মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে গত বছর চিঠি লিখে চৌধুরী নাফিজ শরাফাতের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের কথা তুলে ধরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর, মহীউদ্দীন খান আলমগীর যখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, তখন তার ‘অনুপস্থিতিতে’ ফারমার্স ব্যাংক পর্ষদের এক বৈঠকে একটি অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়। চৌধুরী নাফিজ শরাফাত সে সময় অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান/এমডি হিসেবে বিনিয়োগের ওই অর্থ নেন। তাতে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়। কারণ, তিনি তখন ব্যাংকের একজন পরিচালক এবং আইন অনুযায়ী তিনি পরিচালক থাকা অবস্থায় ফারমার্স ব্যাংক থেকে কোনো তহবিল পেতে পারেন না। সেই অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে এ পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ পদ্মা ব্যাংককে দেওয়া হয়নি, মূল টাকাও ফেরত দেয়নি।
ব্যাংক হিসাব তলব : চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গতকাল আয়কর বিভাগের রাজধানীর কর অঞ্চল-১৫ থেকে দেশের তফসিলভুক্ত ৯১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে এস আলম ছাড়াও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, মা চেমন আরা বেগম এবং ভাই আবদুল্লাহ হাসানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ভাই আবদুল্লাহ হাসান হলেন এস আলম লাক্সারি চেয়ার কোচ সার্ভিস, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেডের পরিচালক। তলবকৃত ব্যাংক হিসাবের মধ্যে তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বা বোনের যৌথ নামে অথবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবও রয়েছে। এ ছাড়া তাদের নামে থাকা ক্রেডিট কার্ডের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও ডাক বিভাগের কাছে থাকা হিসাবের তথ্য চেয়েছে এনবিআর।