ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন (৩৫) নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে হত্যার ঘটনায় আট শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বাতিল করা হয়েছে তাদের হলের সিটও। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ত না থাকলেও ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদকে বহিষ্কার ও তার নামে আশুলিয়া থানায় মামলা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী জুবায়ের বলেন, ‘আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভুল ইনফরমেশনে এমনটি হয়েছে বলে জেনেছি। ভিডিও ফুটেজ দেখে যাকে সাময়িক বহিষ্কার ও মামলার আসামি করা হয়েছে তার নামও জুবায়ের আহমেদ। ভুলক্রমে ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদের ইনফরমেশন দিয়ে অফিস আদেশটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর জন্য প্রক্টরিয়াল কমিটি ও নিরাপত্তা শাখা মিলে একটি সংশোধনী বিবৃতি দেবে এবং মামলায় সঠিক আসামির নাম যোগ করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আট শিক্ষার্থীর বহিষ্কারের বিষয়টি গত রাতে নিশ্চিত করেন প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ।
বহিষ্কৃত আটজনের মধ্যে তিনজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তারা হলেন ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, ২০১৮-১৯ সেশনের ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক আহসান উল্লাহ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক আল হোসাইন সাজ্জাদ, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মুত্তাকীন সাকিন, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের মো. ফিরোজ কবির, একই বর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মো. আবদুস সামাদ ও ওয়াজিবুল সুমন।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন জালাল মিয়া, মোহাম্মদ সুমন, আহসান উল্লাহ, মুত্তাকীন সাকিন, আল হোসাইন সাজ্জাদ ও ওয়াজিবুল আলম।
প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তোফাজ্জল হোসেন হত্যার ঘটনায় হল প্রশাসনের তদন্ত কমিটির তালিকাভুক্ত আটজন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ছয়জনকে আটক করা সম্ভব হয়েছে তবে বাকি দুজন পালিয়ে গেছে। আগামীকাল তাদের বহিষ্কারের বিষয়ে চিঠি ইস্যু হবে। এ ছাড়া তাদের সিট বাতিল করে হল প্রভোস্ট চিঠি দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন এলে তখন আরও কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
এর আগে গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেপ্তার ছয় ছাত্র তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা আদালতে বিচারকের খাসকামরায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে আদালতের নির্দেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ শাহবাগ থানায় মামলা করেন। পরে বিকালেই ঢাবির প্রক্টরিয়াল টিম ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৮ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে কয়েক ছাত্র তাকে আটক করেন। প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্টরুমে নিয়ে তিনি মোবাইল চুরি করেছেন অভিযোগ তুলে এলোপাতাড়ি চড়থাপ্পড় ও কিলঘুসি মারেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করলে তার নাম তোফাজ্জল বলে জানান। মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাওয়ানো হয়। পরে হলের দক্ষিণ ভবনে গেস্টরুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে পেছনে হাত বেঁধে স্টাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কয়েকজন ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়েন। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানালে তাদের সহায়তায় তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষানিরীক্ষা করে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।
পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, তোফাজ্জল ছিলেন বাবা, মা, ভাইবোন হারা। বাবার মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়, মায়ের মৃত্যু ক্যান্সারে আর একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুও হয়েছে ক্যান্সারে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সবকিছু হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে তোফাজ্জলের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মা, বাবা আর ভাইয়ের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি। গতকাল সকাল ৯টায় স্থানীয় একটি মাদরাসা মাঠে তার জানাজা হয়। এ সময় এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। জানাজায় কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয়রা জানান, তোফাজ্জল খুবই হাস্যরসিক লোক ছিলেন। তাকে কখনো কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখা যায়নি। তার এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।
জানাজা নামাজে অংশ নেওয়া মাওলানা নুরুজ্জামান আলমাস বলেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারিনি, শুধু চোখের সামনে ভাত খাওয়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। তোফাজ্জল আমার কোনো নিকটাত্মীয় না।
তবু ওর জন্য মায়া লাগে।’ তোফাজ্জলের মামাতো বোন তানিয়া বলেন, ‘ভাই হত্যার বিচার চাই। পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে হত্যা করে দোষ এড়ানোর জন্য মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করলে মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে।’
তোফাজ্জলের ভাবি লতিফা বেগম বলেন, ‘বুধবার রাত ১০টা ২ মিনিটে আমাকে ফোন দিয়ে তোফাজ্জলকে দিয়ে কথা বলায়। তোফাজ্জল বলে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধরেছে; মারধর করছে, টাকা চায়। এরপর ১০টা ২৮ মিনিটে ফোন দিয়ে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়।’ তোফাজ্জলের মামা আবদুর রব বলেন, ‘বুধবার রাতে আমার কাছেও ৩৫ হাজার টাকা চেয়েছে। টাকা না দিলে তোফাজ্জলকে মেরে ফেলবে। এ খবর শুনে আমার মেয়ে তানিয়া ঢাকায় থাকায় ওর সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করি। পরে বৃহস্পতিবার সকালে খবর পেলাম তোফাজ্জলকে হত্যা করা হয়েছে।’