গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংকট সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত। নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। গতকাল রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডির ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, এনজিওসহ সব অংশীজনকে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে তাদের মতামত নেওয়া উচিত। বেশির ভাগ সময় নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হয় না। এটি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা। নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা একটি প্রকৃত সমস্যা। সুতরাং এটি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংবেদনশীল থাকে। জবাবদিহি প্রক্রিয়া নিয়ে তারা বেশ অস্বস্তি বোধ করে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) পরিচালক নিহাদ কবির ও বাংলাদেশ গার্মেন্টশ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে এক ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সিপিডির একজন প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি হিসেবে সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘আমি আজ বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা আমার শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে। তিনি দেশের বিভিন্ন সময়ে তার ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখে চলেছেন।’ ৩০ বছরের দীর্ঘযাত্রায় দেশে এবং দেশের বাইরে সিপিডি একটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস বলেন, ‘সিপিডি সব সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেছে এবং দেশের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে নীতি-নির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।’ বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিগত সরকারের সময়ে আমাদের যখন কথা বলার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তখন সিপিডির অনুষ্ঠানে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর মত প্রকাশে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতির বাইরে বিশেষ করে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে অনেক ভূমিকা রয়েছে। বিগত আওয়ামী সরকার ভোটাধিকার হরণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভোটের অধিকার হরণ করলে, জনগণের অন্যান্য অধিকার বঞ্চিত করতেই হয়। বর্তমানে এমন একটি পরিবেশ এসেছে, সরকার ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক পার্টির মধ্যেও সংস্কার করতে হচ্ছে। সংস্কার করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কার করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংস্কার হতে হবে, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। কিছু মানুষ বসে চাপিয়ে দিলেই সংস্কার হবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংস্কার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরা আওয়ামী সরকার পতনের অন্যতম বড় কারণ ছিল। তারা যদি মিডিয়ার স্বাধীনতা দিত, তাহলে তার (প্রধানমন্ত্রীর) কাছে অনেক পর্যালোচনার তথ্য পৌঁছাত। কিন্তু মিডিয়ার কণ্ঠরোধের কারণে তাদের কাছে সত্য যেত না। মাহফুজ আনাম বলেন, গত ১৫ বছর মুক্তচিন্তাকে আঘাত করা হয়েছে। আমরা এখনো মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। তিনি প্রশ্ন করেন, আমি ফ্যাসিস্ট সাইকোলজির মধ্য থেকে নতুন অবস্থানে এসেছি। সেই সাইকোলজি থেকে বের হতে পেরেছি? তিনি বলেন, আমাদের জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হবে। আর সংবাদপত্র দৈনিক জবাবদিহি করে। অন্য প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে দেয়, কিন্তু দিনের পর দিন জবাবদিহি নিশ্চিত করে স্বাধীন গণমাধ্যম। পূর্ববর্তী সরকার পতনের অন্যতম বড় কারণ হলো সে মিডিয়ার গলা চেপে ধরেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে তার কাছে সত্য যেত না। সিপিডি জনগণের জন্য বিকল্প মাধ্যম হয়ে উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিপিডির সব মতামত গবেষণামূলক ও তথ্যভিত্তিক। সিপিডির সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক সুদৃঢ়, বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক। অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান বলেন, ভবিষ্যতে দেশের একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকবে, যেখানে সিপিডির মতো প্রতিষ্ঠান নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবে। বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। বহুমত প্রকাশের জন্য নানান ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। সবই যে সরকারের পক্ষ থেকে আসে তা নয়, একটি পক্ষ আছে যারা অন্যের মত শুনতে চায় না। সবাইকে সহিষ্ণু হতে হবে।