বিদায়ি বছর শুরু হয়েছিল ‘আমি আর ডামি’ নামের ভোটারবিহীন বিতর্কিত এক নির্বাচন দিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটো জাতীয় নির্বাচনের পথ ধরেই ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি মঞ্চস্থ হয় শেখ হাসিনার সাজানো নির্বাচনি প্রহসন। বিরোধী দলগুলোর বয়কটের মুখে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের পর তখন কে ভেবেছিল, মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই সরকার তো বটেই, ৭৫ বছর বয়সি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ফেলে দেশ ছাড়তে হবে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী-এমপি, নেতাদের পালিয়ে জান বাঁচাতে হবে। ক্ষমতার মসনদ থেকে দাঁড়াতে হবে বিচারের কাঠগড়ায়।
নির্বাচনের প্রহসন করায় দেশের জনগণ এমনিতেই ছিল ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয় ক্ষমতাসীনদের অবাধ দুর্নীতি ও নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের অনিয়ম-অনাচারের বিরুদ্ধে যথারীতি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে। এর সঙ্গে যোগ হয় শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। বছরের প্রথম দিনেই ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে (পরে প্রধান উপদেষ্টা) ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। বিধাতার কী অমোঘ বিধান, মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে শেখ হাসিনার ক্ষমতার মসনদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্যই বরাদ্দ রেখেছেন ওপরওয়ালা। জুলাইজুড়ে সারা দেশ উত্তাল ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। আগস্টে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে। গত ১৫ বছর ধরে মানুষের ভোট দিতে না পারা, বিরোধী মত দমন, গুম, খুন আর নির্বিচার মামলায় জেলে পুরে রাখার সব ক্ষোভ যেন উথলে ওঠে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে।
৫ জুন সরকারি চাকরির নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিপত্র বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন হাই কোর্ট। প্রতিবাদে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। ৯ জুন দাবি মানতে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন তারা। ১ জুলাই ছাত্র সমাবেশ থেকে চূড়ান্ত সুরাহার জন্য আবারও ৪ জুলাই পর্যন্ত আলটিমেটাম শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি তিন দিনের কর্মসূচিও দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে। এর পর আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক মন্ত্রীর একগুয়েমি, খামখেয়ালিপনা আর শিক্ষার্থীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেওয়া বক্তব্য আগুনে ঘি ঢালে।
১৪ জুলাই চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের বাচ্চা’ শীর্ষক বক্তব্য আন্দোলনের গতি তীব্র করে তোলে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগকে উসকে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর পর আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ।
১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ওয়াসিম, শান্ত, ফারুক এবং ঢাকায় সবুজ আলী ও শাহজাহান নিহত হন। ১৭ জুলাই আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। ১৮ জুলাই পূর্ব ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে মুগ্ধ-ফাইয়াজসহ ৪৮ জন শহীদ হন। এর পর অগ্নিগর্ভে পরিণত হয় বাংলাদেশ। ১৯ জুলাই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা যান আরও ১১৯ জন। র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণে বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। এর পর দেশজুড়ে জারি করা হয় কারফিউ। কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতার মিছিলে ২০ জুলাই শহীদ হন আরও ৭১ জন। দিন যত গড়াতে থাকে মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকে। একই সঙ্গে চলে গণগ্রেপ্তার। ২ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ৯ দফা বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র সমন্বয়করা। এর পর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে থাকে। ৪ আগস্ট বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এ দিনেও ১৩০ জনের মৃত্যু হয়। ৬ আগস্টের বদলে ঢাকামুখী লং মার্চ এক দিন এগিয়ে আনেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ৫ আগস্টও সকাল থেকে রাজধানীজুড়ে সতর্ক অবস্থান নেয় পুলিশ, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি শেখ হাসিনার। রাজপথে নেমে আসেন সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ। বিক্ষুব্ধ মানুষের সব ক্ষোভ উগড়ে পড়ে গণভবন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এ সময় সেনাসদরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। দেশের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করেন। তিন দিন পর ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সারা দেশে দাবির মিছিল ওঠে। নানা দাবিতে রাজপথে নেমে আসে মানুষ। ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ আনসারের কয়েক হাজার সদস্য চাকরির সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ সচিবালয়ের সম্মুখে সমাবেশ করে। সেখানে সেনাবাহিনী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বঙ্গভবন ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বিএনপি এই দাবিতে সায় না দেওয়ায় ওই সময়ে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি স্তিমিত হয়ে পড়ে।
২০২৪ অনেক ঘটনাবহুল বছর হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। কিছু ঘটনা এই সালকে ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত করবে সহজাত নিয়মেই। এই লিপইয়ার ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি’ নামে বহুতল ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে ৪৬ জন গ্রাহকের মৃত্যু হয়। ৭৫ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে এমভি আবদুল্লাহ নামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ ছিনতাই করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। ১৫ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান জাহাজসহ ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক।
২২ মে ভারতের কলকাতার নিউটাউনে অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেন থেকে আওয়ামী লীগের এমপি আনোয়ারুল আজিমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জুনে আলোচিত ছিলেন পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ। সারা দেশে বেনজীরের বিপুল পরিমাণ সম্পদ, জমি ও ফ্লাটের সন্ধান পাওয়া যায়। ১২ জুন আদালত বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। কোরবানির ঈদের সময় ১২ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আলোচনায় আসেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে তরুণ ইফাত। এই পোস্টে শোরগোল পড়ে যায় চারদিকে। নেটিজেনরা মতিউর রহমানের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ২৫ নভেম্বরে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় পতাকার ওপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে তার জামিন আবেদন নাকচ করে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে তার সমর্থকরা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি হয়। বছরের শেষ দিকে এসে ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের অনেক নথিপত্র পুড়ে যায়। দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায় মধ্যরাতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ঘটনার পরদিনই সাংবাদিকদের সচিবালয়ে প্রবেশের সব অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করে সরকার। বছরের শেষদিন আজ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করবেন। এমন চাঞ্চল্যকর সব ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করল ২০২৪।