অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ অধ্যায়ের প্রধান এবং প্রথম কাজ হচ্ছে নির্বাচন সুন্দরভাবে আয়োজন করা। গতকাল সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। বৈঠকের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রেস সচিব। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈঠকের আলোচনার বিষয় জানানো হয়।
ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব জানান, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ৫ আগস্ট আমাদের প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ থেকে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। এ অধ্যায়ের প্রধান কাজ হচ্ছে সুন্দরভাবে নির্বাচন করা। বিচার ও সংস্কার তো আছেই।’ বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কথা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের টাইম লাইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট তারিখ জানাবেন। বিতর্ক এড়াতে এসপি-ওসিদের পদায়নে লটারি হবে। ডিসি (জেলা প্রশাসক) নিয়োগ বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রচুর সভা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা এক মাসে দুটি সভা করেছেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। আরও ৫০ হাজার বাড়তে পারে। সেনাবাহিনী ৬০ হাজার সদস্য দেবে বলেছে। আরও বেশি সদস্য লাগতে পারে। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, তাঁরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে কারও অভিযোগ থাকবে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। তিনি (হাসিনা) যাতে ন্যায়বিচার পান, সেটি নিশ্চিত করা। আলজাজিরা ও বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিনি কী করেছেন। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরকার আশা করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবেন এবং বিচারের মুখোমুখি হবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং প্রশাসন ভেঙে পড়া নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, বিগত সময়ের তুলনায় অপরাধ ও খুন কম হচ্ছে। একটা-দুটা খুন হলেই বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। প্রতি মাসে অপরাধ ও খুনের চিত্র তুলে ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ভেঙে পড়লে এক বছরে এত অর্জন হতো কি না, পাল্টা প্রশ্ন রাখেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পালানোর সময় দেশে খাদ্যের মজুত ছিল ১৮ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ টনে। প্রথমবারের মতো ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্যাংক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, রিজার্ভ বাড়ছে। এসব কারা করছে? আমলাতন্ত্র করেছে। আমলাতন্ত্র ভেঙে পড়লে ছয়টি বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হতো না। পুলিশ যদি সক্রিয়ই হয়, তাহলে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে হলো কেন- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে প্রেস সচিব জানান, চারটি মামলার বিচার শুরু হয়েছে, ২৭টি তদন্তের পর্যায়ে আছে এবং ১৬টির চার্জশিট হয়েছে। তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সফলভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং জুলাইয়ের ৩৬ দিনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালা পরিচালনার জন্য সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে বৈঠকে অভিনন্দন জানায় উপদেষ্টা পরিষদ। বৈঠকে সরকারের এক বছরের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর ৩১ জুলাই পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদ ৪১টি বৈঠক করেছে। ৩১৫টি সিদ্ধান্তের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে ২৪৭টি (৭৮.৪১ শতাংশ)। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে ৬৮টি। অধ্যাদেশ প্রণয়ন হয়েছে ৫৬টি, প্রক্রিয়াধীন ১০টি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ বৈঠকে বলেন, স্বাধীনতার পর যে কোনো সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের রেকর্ড এটি। ১১টি সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। প্রেস সচিব জানান, ‘গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি’র নাম পরিবর্তনের দাবি ছিল। উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এ ইউনিভার্সিটির নতুন নাম হবে ‘ইউনিভার্সিটি অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি বাংলাদেশ’। বৈঠকে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি নিয়ে আবারও আলোচনা হয়েছে। জুলাই শহীদদের মধ্যে যে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে, তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্বজনদের মধ্যে একটা ডিসপিউট দেখা যাচ্ছে। টাকাটা কে কীভাবে পাবেন- এক সপ্তাহের মধ্যে বিধি করে দেওয়া হবে। গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো সচিবালয়ে এসে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা। এ উপলক্ষে সচিবালয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ১ নম্বর গেট ছাড়া সব গেট বন্ধ রাখা হয়। এ গেট দিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয় এবং এখানে সোয়াট টিম মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে। বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদেরও অবস্থান ছিল বিভিন্ন পয়েন্টে। দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ ছিল। নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয় গোটা এলাকা। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাংবাদিকরাও প্রবেশের অনুমতি পাননি। ১ নম্বর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউ আশপাশেও যেতে পারেননি। গত বছরের ২০ নভেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমবার সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে যোগ দেন। তখন তিনি ৬ নম্বর ভবনের ১৩ তলায় মন্ত্রিসভা কক্ষে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এবারের বৈঠকটি নতুন নির্মিত ভবনে হওয়ায় একে নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকগুলো রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা এবং পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে হয়ে আসছিল।