আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দেশ যথেষ্ট প্রস্তুত এবং স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করার ঘোষণা দিয়েছি। এক বছরে দেশ নির্বাচন আয়োজন করার মতো যথেষ্ট প্রস্তুত এবং স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। নির্বাচনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গায় নির্বাচিত একটি সরকার দায়িত্ব নেবে। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি এখানে এসেছি। এক বছর আগে আমরা দেশকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে এক হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এখন আমরা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত। আমরা নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছি। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গায় নির্বাচিত একটি সরকার দায়িত্ব নেবে। আমরা আশা করি, রোহিঙ্গাদের নিজেদের ঘরে ফিরে যাওয়ার একটা সমাধান বের করতে পারব।
অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান কেবল বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমারের সৃষ্টি। সমাধানও তাদের ওপর নির্ভর করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ ও কার্যকর চাপের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তাদের একমাত্র স্বদেশ মিয়ানমার। আট বছর ধরে বাংলাদেশ তাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু সমস্যার মূলোৎপাটন হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, নতুবা এ অঞ্চল দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন, খাদ্য সহায়তা জোরদার করা এবং রোহিঙ্গাদের মনোবল ধরে রাখতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এর আগে, সকাল ১০টার দিকে সংক্ষিপ্ত সফরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস। সেখান থেকে তিনি সরাসরি সম্মেলনস্থল ‘হোটেল বে ওয়াচে’ যান। গত রবিবার শুরু হওয়া ‘টেক অ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক এ তিন দিনের সম্মেলন আজ শেষ হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রোহিঙ্গা ইস্যু বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দপ্তর যৌথভাবে এ আয়োজন করেছে। এতে অংশ নিচ্ছেন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় সব স্টেকহোল্ডারসহ অন্তত ৪০টি দেশের প্রতিনিধি। আজ শেষ দিনে বিদেশি অতিথিরা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সেখানে তারা সরাসরি বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে বর্তমান দুঃসহ জীবনের কথা শুনবেন। কূটনৈতিক মহল মনে করছে, উচ্চপর্যায়ের এ সম্মেলন থেকে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বা উদ্যোগ ঘোষিত হলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নিরসনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার সাত প্রস্তাব : সাত প্রস্তাবের প্রথমটিতে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে হবে। এ জন্য তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনে দ্রুত একটি বাস্তব রোডম্যাপ তৈরি করতে সবাইকে আহ্বান জানাই। আর সময় নষ্ট না করে এখনই কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জীবন রক্ষাকারী কাজ চলমান রাখতে দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অপরিমিত অবদান এখানে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই অর্থায়ন করার পদক্ষেপ নিতে অংশীজনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের প্রতি সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করতে আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানাই। পাশাপাশি আর কোনো রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে না আসে তা মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে দিতে হবে।
চতুর্থত, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতা বন্ধ, জাতিগত নিপীড়ন রোধে পরামর্শ কিংবা সংলাপের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিতে, স্বেচ্ছায় নিরাপদ প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইন কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই।
পঞ্চমত, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিশেষ করে আসিয়ানকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনাদের সবার সহযোগিতা এই সংকটের সমাপ্তি টানতে পারে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সচল হওয়ার আহ্বান জানাই।
ষষ্ঠত, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অবশ্যই জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সপ্তমত, ন্যায়বিচার, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাই।