একটি রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হলো রাজনীতি। আর রাজনীতির মেরুদণ্ড হলো অর্থনীতি। রাজনীতি আর অর্থনীতি সমান্তরাল রেললাইনের মতো। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। রাজনীতি বিনিয়োগ এবং ব্যবসাবান্ধব না হলে যেমন অর্থনীতি গতি হারায়, তেমনি অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লে রাজনীতি বিপন্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই চিরায়ত সমাজ দর্শন উপেক্ষিত হয় সব সময়। এ কারণেই স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমাদের রাজনীতি এবং অর্থনীতি কোনোটাই সঠিক পথে এগোয়নি। রাজনীতিতে যেমন বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। জনগণের অধিকার হরণ করা হয়েছে। গণতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের ওপর চেপে বসেছে স্বৈরশাসন। তেমনি অর্থনীতিতে প্রচুর সম্ভাবনা থাকার পরও আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। একটি দেশের রাজনীতিই অর্থনীতির রূপকল্প তৈরি করে। রাজনৈতিক নীতি ও দর্শনই ঠিক করে অর্থনীতির গতিপথ। আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি এবং অবস্থানের যেমন মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, তেমনই অর্থনীতিও একটি নির্দিষ্ট সড়কে চলতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু করে। বেসরকারি খাতকে বন্ধ রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর লাখো তরুণ যারা চাকরি না করে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করা হয়।
অনিবার্যভাবে হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং কর্মহীন তরুণের সংখ্যা বাড়ে। বিভ্রান্ত তরুণ সমাজ ভুল পথে পা বাড়ায়। কর্মহীন তরুণরা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিতে। ৭৫-এর পর বাংলাদেশ প্রথম মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করে। এখান থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা এগিয়ে যেতে শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বেসরকারি খাতই হয়ে ওঠে অর্থনীতির প্রাণভোমরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই শুধু নিজেদের পরিশ্রম, মেধা আর দক্ষতা দিয়ে আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা তলাবিহীন ঝুড়িকে এক অফুরন্ত সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পুরো কৃতিত্ব আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু গত অর্ধ শতকে আমরা বেসরকারি খাতকে যেন এতিম সন্তানের মতো অনাদরে, অযত্নে রেখেছি। রাষ্ট্রীয় কোনো সহযোগিতা যেমন বেসরকারি খাতে দেওয়া হয় না, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বেসরকারি খাত নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলোই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিভক্ত করে, বেসরকারি খাতে দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটায়। রাজনীতিবিদরা ব্যবসায়ীদের দলে ভেড়াতে উৎসাহী হন মূলত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। শুরু হয় ব্যবসায়ীদের দলীয়করণ। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলই ব্যবসায়ীদের একান্ত অনুগত করে রাখতে চায়। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে গ্যাসের লাইন কিছুই পাওয়া যাবে না- এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি। শিল্প বাঁচাতে, প্রতিষ্ঠান রক্ষায় প্রায় সব উদ্যোক্তাকে সমঝোতার পথে যেতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো অর্থনীতিকে আরেকটি বড় ক্ষতি করে। দলের অনুগত কর্মীদের রাতারাতি ধনী বানানোর মিশন শুরু করে। শুরু হয় টেন্ডারবাজি। রাজনৈতিক কর্মীরা বনে যান ঠিকাদার কিংবা ব্যবসায়ী। লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদি নানাকিছু কর্মীদের হাতে তুলে দিয়ে অর্থনীতিতে শুরু হয় দুর্বৃত্তায়ন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালক পদে বসানো শুরু হয় দলীয় ক্যাডারদের। এখান থেকেই শুরু হয় ব্যাংক লুটের অধ্যায়। এমন সব প্রতিষ্ঠান এবং মানুষকে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয় যেসব প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন। এরা বিনিয়োগের জন্য নয় লুটপাট ও নেতাদের পকেট ভারী করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এসব ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয় বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স। ঝুঁকিতে ফেলা হয় গ্রাহকদের আমানত। এতে সমস্যায় পড়েন প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা। সুদের হার বাড়িয়ে এবং নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা কঠিন করে তোলা হয়। অনেক উদ্যোক্তা ব্যাংকিং খাতের দুষ্টচক্রের ঋণ খেলাপি হতে বাধ্য হন। উচ্চ সুদের কারণে বহু উদ্যোক্তা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। কেউ বিদেশে চলে যান। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেন ব্যবসা করাটাই অপরাধ। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে যেন উদ্যোক্তারা মহা অন্যায় করেছেন।
যেসব উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী সরকারের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন, তাদের ওপর হামলে পড়ে এনবিআরসহ নানা সরকারি সংস্থা। এভাবেই অফুরন্ত সম্ভাবনাময় বেসরকারি খাত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে বিদেশিদের উন্নয়ন সহায়তার অর্থ খরচের জন্য গড়ে ওঠে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও। গরিব মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন তাদের কাজের প্রধান লক্ষ্য হলেও তারা আসলে দাতাদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। গরিব মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও এসব উন্নয়ন সংস্থার কর্ণধারদের জীবন পাল্টে দেয় বিদেশি সাহায্যের টাকা। বিনা পুঁজিতে, বিনা পরিশ্রমে এনজিওদের দামি অফিস, গাড়ি এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু হয়। সমাজে একটি নতুন এলিট শ্রেণি তৈরি হয়। এরা একদিকে পরিকল্পিতভাবে যেমন বিরাজনীতিকরণ চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে, তেমনি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম নেতিবাচক অপপ্রচার চালায়। উন্নয়ন সহযোগিতার আড়ালে এরা সবসময় চায় বাংলাদেশ যেন ঋণনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে। কারণ বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হলে, বিদেশি সহায়তা বন্ধ হবে বা কমে আসবে, এতে তাদের বিত্তবৈভব কমে যাবে। ফলে, আশির দশকের শেষ দিকে বিকাশমান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বেসরকারি ব্যবসা-বিনিয়োগের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। বিদেশি টাকায় এবং সহযোগিতায় তারাও ব্যবসা করা শুরু করে, উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে তাদের ওপর সরকার কম কর ধার্য করে। তাদের অনেক ব্যবসা করমুক্ত করা হয়। বেসরকারি খাতকে ঠেলে দেওয়া হয় আরেক অসম প্রতিযোগিতায়।
এরকম বৈরী বিনিয়োগ পরিবেশের মধ্যে জুলাই বিপ্লব ঘটে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের আপামর জনগণ, স্বৈরাচারের পতন ঘটায়। নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ তৈরি করেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র সংস্কারে অর্থনীতি উপেক্ষিত। বাংলাদেশ বেসরকারি খাতকে কীভাবে এগিয়ে নেবে সেই আলোচনা কোথাও নেই। আগামীর বাংলাদেশ কতটা বিনিয়োগবান্ধব হবে, সেই রূপকল্প নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। বরং ৫ আগস্টের পর, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের যেন প্রতিপক্ষ বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই ১৪ মাসে হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, দখল- কী হয়নি। যারা লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে হয়রানি করা হচ্ছে, মাসের পর মাস। তথাকথিত তদন্তের নামে বেসরকারি খাতের চরিত্র হননের মিশন চলছে। গোটা বেসরকারি খাত এখন আতঙ্কিত, হতাশ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার অভিযাত্রায় বেসরকারি খাতকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বেসরকারি খাত নিয়ে আগ্রহ নেই। বরং এই সরকারের কেউ কেউ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে যেন রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে এলেন। অধিবেশনের ফাঁকে তিনি বিনিয়োগবিষয়ক বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। কিন্তু একজন বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে জায়গা পাননি। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বাদ দিয়ে কি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে?
আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেছে। এই প্রচারণায় বেসরকারি খাত উপেক্ষিত। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে বেসরকারি খাতকে কীভাবে পরিচালনা করবে? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর নেই। আবারও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষমতাসীনদের অনুগত বানাতে বাধ্য করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। বহতা নদী যেমন বাধাগ্রস্ত হলে শুকিয়ে যায়, তেমনি বেসরকারি খাতে এভাবে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে অচিরেই তা মুখ থুবড়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অর্থনীতি পড়বে গভীর সংকটে। তাহলে রাজনীতিও হবে অস্বস্তিকর। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। আমরা সেই পুরোনো বৃত্তেই বন্দি হয়ে রইব।
লেখক ও নাট্যকার
ইমেইল : [email protected]