শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাহারি জামদানি

বাহারি জামদানি

♦ মডেল : শামীমা তুষ্টি ♦ পোশাক : টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির ♦ ছবি : রাফিয়া আহমেদ

আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গী জামদানি শাড়ি।
একটি জামদানি যেন প্রতিটি বাঙালি নারীর কাছে শখের এক টুকরো বস্ত্র। যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীর অনেক আবেগ অনুভূতির গল্প মিশে আছে এ শাড়িতে। এ যুগে নারীদের আকর্ষণীয় লুকে উপস্থাপন করতে জামদানি অতুলনীয়। জামদানির আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন-  তানিয়া তুষ্টি

 

পার্সিয়ান শব্দ থেকে এসেছে জামদানি। জাম অর্থ ফুল আর দানি অর্থ পাত্র। সে হিসেবে আপনি জামদানি না বলে ফুলদানি বললেও ভুল হবে না। কিন্তু হস্তশিল্প জামদানি আমাদের কাছে গৌরবময় ইতিহাস আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি শিল্পের নাম। শুরুর দিকে সুক্ষ্ম মসলিন সুতায় বোনা জমিনের ওপর হাতে বোনা হতো বাহারি ফুল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা থেকে বেরিয়ে সিল্কের ওপরও জামদানির কাজ হচ্ছে। বর্তমানে শুধু ফুল ছাড়াও অন্য অনেক কারুকার্যের জামদানি শাড়ি তৈরি হয়।

 

বাঙালি নারীর শখের শাড়ি

বাঙালি নারীর সঙ্গে জামদানি শাড়ি সেই আবহমান কাল থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রিয় এক একটি শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক মধুর ¯ঙৃতি। যুগের পালা বদলে কতো ধরনের পোশাকের প্রচলন ঘটল, তবু জামদানির কদর কমল না এতটুকু। এখনো প্রতিটি নারীর কাছে একেকটি জামদানি শাড়ি অত্যন্ত শখের, সঙ্গে যত্নেরও বটে। হুটহাট যে কোনো  অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ শাড়ির তুলনা নেই। বিয়ে, জন্মদিন, আড্ডা বা বেড়াতে যেতে জামদানির তুলনা নেই। তাছাড়া অফিস-আদালত কিংবা কোনো সভা-সেমিনারে যোগ দিতেও এ শাড়ি মানিয়ে যায় সুন্দরভাবে। অথচ উপলক্ষ অনুযায়ী অন্য যে কোনো শাড়ি পরতেই আপনাকে একটু হলেও ভাবতে হয়। এ ছাড়া বাঙালি কালচারাল উৎসবেও জামদানিই সেরা। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি উপস্থাপনে জামদানি থাকে সবার আগে। এ শাড়ির নকশার কারুকার্য আর রঙের উজ্জ্বলতা সহজেই যে কারও নজর কেড়ে নেয়। এমন একটি শাড়িতে যে কোনো সাজেই নারী উপস্থাপিত হয় অনন্য রূপে। কেউ চাইলে ভারি মেকআপে জমকালো লুক আনতেও পারেন, আবার সাদামাটা লুকে উপস্থাপন করতেও এ শাড়ির জুড়ি নেই। আর তাই হয়তো বাঙালির হৃদয়ে জামদানির এমন আদুরে অবস্থান। কাউকে উপহার হিসেবে একটি জামদানির তুলনা হয় না। বিদেশের কাছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক উপস্থানেও আসে জামদানির নাম।

 

বিচিত্র নকশার উৎস

জামদানিতে বিচিত্র নকশার উৎস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও মতে, জামদানির নকশায় ইরান, ইরাক ও তুর্কি কার্পেট ও লৌকিক নকশার প্রভাব রয়েছে। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, মুঘল সম্রাটেরা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ফারসির অনুরাগী ছিলেন। বিভিন্ন সময় অনেক ইরানি চারু ও কারুশিল্পীকে তারা ভারতে এনেছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্ন সময় ফারসি সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেই সূত্রে ইরানি, ইরাকি বা তুর্কি নকশা জামদানির প্রচলন হয়ে থাকতে পারে। জামদানি মূলত কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। জামদানি বোনার সময় আলাদা একটি সুতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলেন কারিগররা। জামদানি বয়ন এতই সুক্ষ্ম আর অতুলনীয় যে এ পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি সব যুগেই বাঙালি নারীর কাছে অতি পরিচিত। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝান হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা, থ্রিপিসসহ আরও অনেক কিছু তৈরি হচ্ছে। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এ ছাড়া, মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হতো।

 

ধরনভেদে জামদানি শাড়ি

জামদানি সাধারনত দুই ধরনের হয়ে থাকে, সুতি ও হাফসিল্ক। আমরা জানি যে জামদানি শাড়ির জমিন এবং ডিজাইন পুরোটা সুতা দিয়ে তাঁতের মাধ্যমে হাতেবোনা হয়ে থাকে। তাই এর দামটাও অন্য শাড়ির তুলনায় একটু বেশি। তবে জামদানি শাড়ির দাম নির্ধারণ করা হয় এর ডিজাইন ও সুতার বুননের ওপর। হাফসিল্কের জামদানি শাড়িগুলোই আসলে অরিজিনাল জামদানি। রেশম সুতাগুলোও ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যে শাড়িগুলো ৩-৫ হাজার টাকার মধ্যে সেগুলোতে এক ধরনের রেশম সুতা দেওয়া হয়। যেগুলো ৬-৮ হাজারের, সেগুলোতে মধ্যম মানের আর যেগুলো ৯ থেকে শুরু হয়, সেগুলোতে উন্নত মানের রেশম ব্যবহার করা হয়। এগুলোতে রেশম ও কটন সুতা ব্যবহার করা হয়। আর মোটিফ অর্থাৎ যে কাজগুলো করা হয়, সেগুলোও করা হয় উন্নতমানের সুতা দিয়ে। তাই এ শাড়িগুলোর ব্যাপারে ব্যবহারকারীর খুব যত্নশীল হতে হয়। আর এক ধরনের জামদানি আজকাল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলো নাইলন সুতা দিয়ে বানানো হয়। এসব শাড়ির মূল্যও হয় ১ হাজার টাকা বা এর নিচে।

 

জামদানি শাড়ির ইতিহাস

জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে। পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বইতে এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালির পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনাতে উঠে এসেছে জামদানির কথা। কৌটিল্যের বইতে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় সুক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে ছিল ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী। নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তার গ্রন্থ স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে রুমি নামের রাজ্যে সুক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুসারে বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও এলাকায় অবস্থিত সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ঢাকার মসলিনের প্রশংসা করেছেন।

 

জামদানি শাড়ির যত্ন

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের বাহন এ এক টুকরো শাড়ির যত্নের কথাও আমাদের মাথায় রাখতে হয়। এত টাকা দিয়ে কেনা শাড়িটি কয়েক বছরে নষ্ট হলে মনটা ভেঙে যায়। তাছাড়া অন্যান্য শাড়ির মতো জামদানি শাড়ি যেনতেন করে রাখলেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই আসুন জেনে নেওয়া যাক শখের জামদানি শাড়িটির যত্ন নিতে হবে কীভাবে।

 

► জামদানি শাড়ি ব্যবহারের পর ভাঁজ করে অনেক দিন রেখে দিলে তা ভাঁজে ভাঁজে ফেঁসে যেতে পারে। আবার হ্যাঙ্গারে করে ঝুলিয়ে রাখলেও শাড়ি মাঝখানে ফেটে যায়। তাই জামদানি শাড়ি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে বা ভাঁজ করে রাখতে নেই। রোল করে রাখতে পারেন কোনো শক্ত কাঠের ওপর। এভাবে রাখলে জামদানি কখনোই নষ্ট হবে না।

► হাফসিল্ক জামদানি শাড়ি অন্যান্য সাধারণ শাড়ির মতো ঘরে ধুতে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে নিশ্চিত। তাই ঘরে না ধুয়ে ড্রাইওয়াশ করানো ভালো।

► কিছুদিন পর পর শাড়িগুলো খুলে রোদে দিয়ে ভালো করে বাতাসে ঠান্ডা করে আবার যত্ন সহকারেই আলমারিতে রেখে দেবেন। মনে রাখবেন রোদ থেকে এনে সঙ্গে সঙ্গেই তা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলে আপনার শাড়িটি আর ভালো থকার সম্ভাবনা নেই।

► জামদানি পরার পর যদি কোনো দাগ পড়ে যায়, তাহলে তা নিজের হাতে ঘষে ঘষে না উঠিয়ে সেখানে ট্যালকম পাউডার ছিটিয়ে দিন, তারপর ড্রাই ক্লিনিংয়ে দিন।

► জামদানির নিচের পাড়ে অবশ্যই ফলস পাড় লাগিয়ে নেবেন কেনার পর পরই, তাহলে ময়লা বা জুতার ঘয়ায় নিচের পাড়টা নষ্ট হবে না, টেকসই থাকবে।

► সুতি জামদানিগুলো যদি ১০০ ভাগ কটন সুতার হয়, তাহলে ধুতে পারেন। কিন্তু যদি হালকা রেশম মিক্সড থাকে, তাহলে ধোওয়া উচিত নয়। তাই আগে নিশ্চিত হন শাড়িটি শতভাগ কটন কি না। এ জন্য শাড়ির আঁচলের শেষ মাথার সুতাগুলো হাত দিয়ে দেখুন।

► ২-৩ বার পরার পরই জামদানিতে মাড় দিয়ে নেবেন। এতে শখের জামদানিটি দীর্ঘদিন ভালো থাকবে। কয়েকবার পরার পর তৈরির সময় দেওয়া মাড় নষ্ট হয়ে যায়। আর তখনই শাড়ি নেতিয়ে পড়ে। কিন্তু মাড় দিয়ে নিলে একদম নতুনের মতো হয়ে যাবে আপনার প্রিয় শাড়িটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর