বিগত তিন দশক ধরে মানবজাতি ধীরে ধীরে অসংক্রামক ব্যধির প্রাদুর্ভাব প্রত্যক্ষ করছে। অসংক্রামক ব্যধির মধ্যে মৃত্যুহার বিবেচনায় হৃদরোগ এর পরই ক্যান্সারের অবস্থান। কিন্তু চিকিৎসা ব্যয়ের দিক থেকে ক্যান্সার বহুগুন ছাড়িয়ে যায় হৃদরোগকে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ও শিক্ষা) এর মধ্যে প্রতিটি পরিবার চিকিৎসা ব্যতীত বাকি চারটির জন্য অর্থ সঞ্চয় করে। তাই ক্যান্সার এর মত এমন ব্যায়বহুল চিকিৎসার আকস্মিক অর্থব্যায় মানুষকে হতভম্ব করে ফেলে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে দেড় লক্ষাধিক লোক নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ধরণভেদে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যায় শুরু হয় রোগ নির্ণয় থেকে। রোগ শনাক্ত এবং বিস্তার বোঝার জন্য সিটি স্ক্যান, এম আর আই, পেট সিটি স্ক্যান, বায়প্সিই, হিস্টোপ্যাথলজি, ইমিউওনোহিস্টোকেমিস্ট্রি পরীক্ষাগুলো বেশ ব্যয়বহুল। এই পরীক্ষাগুলো পরবর্তিতে চিকিৎসা চলাকালীন এবং চিকিৎসা শেষে, ফলো আপে পুনরায় করতে হয়। সবধরনের পরীক্ষা একই হাসপাতালে না হওয়ায় অনেক সময় বাসস্থান থেকে অন্যস্থান যাওয়ার জন্য মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় হলে, বিশেষজ্ঞরা সার্জারী পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সার্জারির খরচ শরীরের অংগভেদে ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষাধিক টাকা খরচ বহন করতে হয়। ক্যান্সার রোগীদের খরচের প্রধান অংশ হল কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপি প্রতি ২/৩ সপ্তাহ পরপর হয় এবং প্রতিটি সাইকেল থেরাপিতে গড়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। সাধারণত ৬ থেকে ১২ সাইকেল পর্যন্ত রোগীদের কেমোথেরাপি গ্রহণ করতে হয়। ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক আবিষ্কার ইমুনোথেরাপি যা প্রতিটি সাইকেলে ২ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
সবমিলিয়ে চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গড়ে ৯-১০ লক্ষ টাকা (সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা- জরায়ুমুখ ক্যান্সার এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা কোলন ক্যান্সার) একটি পরিবার খরচ করে। সরকারি হাসপাতাল এবং রোগের বিস্তার কম হলে খরচ অনেক কম হয়। এই খরচের হিসাব আমাদের দেশীয় সমীক্ষা অনুযায়ী রোগীদের একটা বিরাট অংশ প্রতিবছর দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ করে। দেশের ডাক্তারদের উপর আস্থার অভাব এবং দালালের প্ররোচনায় অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান দারিদ্রসীমা অতিক্রমের অন্যতম প্রধান কারণ আকস্মিক স্বাস্থ্যব্যয় (৬১.৭%) এবং অসংক্রামক ব্যাধি (১৪.২৯%)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা খাতে যত খরচ হয় তার ৭৪% যায় ব্যক্তির পকেট থেকে।
প্রতিকারঃ
ক্যান্সার সম্পর্কে জনমনে ব্যাপক সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। অনেকে (স্তন এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার রোগী) লোক লজ্জার ভয়ে ক্যান্সারের একেবারে শেষ ধাপে চিকিৎসার শরণাপন্ন হন যখন তা নিরাময়যোগ্য থাকে না। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে যায়। বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ক্যান্সার রোগীকে এক কালীন ৫০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও ও দাতা সংস্থা ক্যান্সার রোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। রোগীদের আমাদের দেশে চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহী করার জন্য সরকারি সেবার মান আরও বাড়ানো প্রয়োজন। রোগী বিবেচনায় দেশে ৩০০টি রেডিওথেরাপী মেশিন প্রয়োজন কিন্তু রয়েছে মাত্র ৩৭টি (সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে)। তাই সরকারের নীতিনির্ধারকরা রেডিওথেরাপীর সুযোগ বৃদ্ধি, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কেমোথেরাপী ঔষধ বিপণন, দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো আর আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা না করলে ক্যান্সার রোগীদের দুর্দশা ও হতাশা থেকে মুক্তি মিলবে না।
লেখক: স্পেশালিস্ট, অনকোলজি বিভাগ ইউনাইটেড হসপিটাল।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন