১. ১৭ এপ্রিল। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী। শপথ হলো। বিশ্ব জেনে গেল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ছিলেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় গণপরিষদ। ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার সনদ’ প্রণীত হয় যার ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় অনুষ্ঠিত হয় শপথ। এই সরকারের নাম হবে মুজিবনগর সরকার। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশকে পাকিস্তান সামরিক হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে।
২. এম মনসুর আলী ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনা শেষে পাবনায় ফেরার জন্য চেনা পথ হিলি জয়পুরহাট বগুড়ার পথকে নিরাপদ মনে করে হিলি সীমান্তে চলে এলাম। বর্ডার সিল। ওপারে পাকিস্তান বাহিনী দখল করে নিয়েছে। হিলিতে এসেই সংকটের আবর্তে জড়িয়ে গেলাম। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার প্রায় এক-দেড়শ সৈন্য ও অস্ত্রসহ একটি গুদাম ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। বিষণœ, ক্লান্ত সৈনিকদের নিয়ে তিনি মহা অসুবিধায়। তাদের খাবার নেই। থাকার ব্যবস্থা নেই। রেশন নেই। এমতাবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা ছিল বিমর্ষ, রণক্লান্ত এবং হতাশাজনিত উত্তেজনায় আকীর্ণ। এ অবস্থায় কী করা যায়, এই ভেবে প্রথমে গেলাম বালুরঘাটে এসডিও এবং ডিএসপির সঙ্গে দেখা করতে, সহযোগিতা চাইতে। প্রশাসন থেকে কিছু অর্থ পাওয়া গেল। স্থানীয় এমএলএ কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন চাল, ডাল, তৈজসপত্র দিয়ে সাহায্য করলেন রাধা বল্লভ বস্ত্রালয়ের দোকানদার।
৩. ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে সীমান্তে তাড়িত ইপিআর সেনা সদস্য ও পুলিশ আনসারদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হলো। এ উদ্দেশ্য নিয়ে বালুরঘাট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় কামারপাড়ার কুরমাইল নামক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমরা আশ্রয় খুঁজে পাই। মূলত সেই দুঃসময়ে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আন্তরিক ও সৌহার্দপূর্ণ। ক্যাম্প স্থাপনের পরপরই বানের জলের মতো বগুড়া, দিনাজপুর, জয়পুরহাটের টগবগে তরুণরা দলে দলে ক্যাম্পে ভিড় জমাতে থাকে। বলতে গেলে বেসরকারি পর্যায়ে সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংগঠিত ক্যাম্প, যেখান থেকে একাধারে যুবকদের ট্রেনিং দেওয়া হতো এবং গেরিলা কায়দায় হিলি, জয়পুরহাট, বগুড়া ও ফুলবাড়ী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালানো হতো। স্বাভাবিকভাবেই এ সময় সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার।
৪. সেদিনের কথা আজও ভোলার নয়। আকাশে মেঘ ছিল না। দিনটি ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের সঙ্গে একটি উইলি হুডখোলা জিপ। তিনি বললেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনার ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। বালুরঘাটের রাস্তা ধরে শহর থেকে বেশ কিছু দূরে একটি নির্জন পরিত্যক্ত স্থান। দেখে মনে হলো কোনো এক সময় যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত বিমানঘাঁটি। আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছানোর পরপরই সাদা পোশাকে একজন চৌকশ সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তি আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভবন অভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম খাপ খোলা তলোয়ারের মতো সামরিক পোশাকে এক শিখকে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
এগিয়ে এসে হাত বাড়ালেন। করমর্দন করলাম। ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাকে যথারীতি স্যালুট দিলেন। এ পর্যায়ে নির্বাচিত এমএনএ হিসেবে যখন ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমার নাম বললেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তিনি সামরিক ভঙ্গিতে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন।
আমার না বসা পর্যন্ত টেবিলে বসলেন না। আমরা একটি ছোট টেবিলে বসলাম। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জনগণের মনোভাব, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মন মানসিকতা এবং সর্বোপরি তরুণদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানতে চাইলেন। এ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন আনোয়ার সামরিক অবস্থা ও অসুবিধার এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। যে লোকটিকে নিয়ে আমি কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা। যুদ্ধরীতি ও পদ্ধতির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলাম। বিনম্র চিত্তে তিনি বললেন, “আপনাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে আপনাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে তা বলে গেছেন। দিয়ে গেছেন দিকনির্দেশনা। যে নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, সেই পথে আপনাদের অগ্রসর হতে হবে, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শত্রুকে পরাস্ত করতে হবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।” “আপনারা আপনাদের নেতার ৭ মার্চের ভাষণ যদি গভীরভাবে পাঠ, অনুধাবন এবং বিশ্লেষণ করেন তাহলেই আপনাদের যুদ্ধরীতি ও পদ্ধতি কী হবে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্পষ্টতই তিনি গেরিলা যুদ্ধের কথাই বলে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। বলেছেন, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। বলেছেন, গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি। ভাতে মারবো। পানিতে মারবো। বলেছেন, স্বাধীনতার কথা। মুক্তির কথা। অগাধ শ্রদ্ধায় জেনারেল অরোরা বলেন, আপনারা এমন এক মহান নেতা পেয়েছেন যিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনে এবং অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্রকরণের চূড়ান্ত পথ ও পদ্ধতির নির্দেশ করে গেছেন। জাতিকে প্রস্তুত করেছেন।
৫. ২৩ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাঁর সঙ্গীয় সেনা সদস্যদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করলেন। ইতোমধ্যেই পাঁচবিবি, বাংলাহিলি, দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, বগুড়া থেকে শ’দুই তরুণ ক্যাম্পে এসে যোগ দিয়েছে। আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে বললাম, আগে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদের ব্যবস্থা করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে ওইদিন হিলি স্টেশনে একটি মালবাহী ট্রেন এসে থামলো। জানতে পারলাম উক্ত ট্রেনে পাকিস্তান বাহিনীর জন্য চাল, ডাল, আটা, গম, তেল, লবণ ফুলবাড়ির দিকে যাচ্ছে। হিলি স্টেশনটি এমন যে, রেললাইনের এ পাশে ভারত ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে অর্ধশত সৈন্য ও তরুণদের নিয়ে কয়েকটি বগির সিলগালা ভেঙে কয়েক শ বস্তা চাল, ডাল, আটা, গম, তেল, লবণ নিয়ে আসা হলো। বলা বাহুল্য, ক্যাপ্টেন আনোয়ার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কিছু সৈন্যদের আক্রমণ হলে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাখলেন এবং আনীত বস্তাগুলো ভারতীয় হিলি স্টেশনে জমা করা হলো। এভাবে রসদের বিশেষ করে খাদ্যের এক বিরাট ভান্ডার আমরা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলাম। পাশাপাশি ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল মুখার্জির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হয়। প্রথম দিকে ইপিআরের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞগণ ছেলেদের বিস্ফোরক ট্রেনিং, গ্রেনেড ছোড়া এবং অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
৬. এপ্রিল মসের ২৬ তারিখে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী, মেজর সাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী খান এবং তোফায়েল আহমদ ক্যাম্পে আকস্মিকভাবে এসে হাজির হলেন। মেজর সাফায়াত জামিল ক্যাম্পে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও আমাকে নিয়ে আমাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ, গুদাম ঘর পরিদর্শন করলেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন আনোয়ার তার সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র এবং যতদূর সম্ভব রসদ সামগ্রী নিয়ে তুরা পাহাড়ের অভিমুখে রওনা হয়ে গেলেন।
৭. ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও তার সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পরপরই মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই বিস্ফোরক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও প্রাথমিক অস্ত্র চালানোর জন্য বিএসএফ থেকে একজন বিশেষজ্ঞ এলেন। বেশ কিছু ইপিআর সদস্য কুরমাইল ক্যাম্পে এসে যোগদান করেন। সুবেদার মেজর রব সাহেব অপারেশন ক্যাম্পে আমাদের সক্রিয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু দিন নিয়োজিত ছিলেন। ওই সময় ইপিআরের হাওয়ালদার মেজর বেল্লাল হোসেন ও জোয়ান ফেরদৌস ট্রেনিংয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যান।
৮. কুরমাইল ক্যাম্পে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রাজেশ্বর রাও আগস্টের শেষ দিকে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবেই এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র যে পরাজিত হবে, এ সম্পর্কে দৃঢ়তার সঙ্গে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তাঁকে ক্যাম্প থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এর পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক এনায়েতুর রহিম প্রায় ১০ দিন কুরমাইল ক্যাম্পে অবস্থান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার এন্ড দ্য নিক্সন হোয়াইট হাউস ১৯৭১’ শীর্ষক বইতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। ড. এ আর মল্লিক আমাদের চাহিদা মোতাবেক তার সুযোগ্য পুত্র ফারুক মল্লিকের মাধ্যমে একটি পাওয়ারফুল বাইনোকুলার আমাকে প্রদান করেন। যার মাধ্যমে উঁচু টাওয়ার থেকে সাত কিলোমিটার পর্যন্ত শত্রুদের অবস্থান জানতে পারতাম।
৯. মে মাসের শেষের দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপকভাবে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীদের চাপ সৃষ্টি হয়। পাবনা এলাকা থেকে, বিশেষ করে আমার নির্বাচনি এলাকার মধ্যে সুজানগর, সাথিয়া ও বেড়া থানা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ উপস্থিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই যারা বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং নিচ্ছিলেন তারা প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে বিপর্যস্ত অবস্থায় ক্যাম্পে এসে হাজির হন। অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন যাদের কুরমাইল ক্যাম্প থেকে দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে, পাহাড়-জনপথ-জলপথ ভেঙে রৌমারি থেকে পদ্ম-যমুনা বিধৌত এই এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার এস এম আমির আলী। সিরাজগঞ্জ এলাকার লতিফ মির্জার সঙ্গে একত্রে আমির আলীকে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। লতিফ মির্জা তিনবার ক্যাম্পে এসে অস্ত্র নিয়েছেন। উচ্চতর ট্রেনিং নিয়েছেন।
১০. বিভিন্ন সময়ে গেরিলা যুদ্ধে কুরমাইল ক্যাম্প থেকে পাঠানো বহু মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন। কুরমাইল ক্যাম্পের প্রাঙ্গণে ১১ জন শহিদকে কবর দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্প থেকে প্রথম ব্যাচে গেরিলা দল পাঠানো হয় খোকনের নেতৃত্বে। খোকন ও তার দল রাজাকার ও পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং প্রায় গোটা দলসহ শহিদ হন। এরকম বেদনাময় বহু স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ক্যাম্প কুরমাইলকে জড়িয়ে আছে।
১১. বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান জুন মাসে এক সপ্তাহব্যাপী উত্তরবঙ্গের ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে তদানীন্তন সরকারের কাছে একটি লিখিত রিপোর্ট দেন। সেখানে কুরমাইল ক্যাম্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আমি যে সমস্ত ক্যাম্প পরিদর্শন করেছি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্যাম্প হলো কুরমাইল ক্যাম্প। ১৩ জুন ক্যাম্পে অবস্থিত ৭০০ প্রশিক্ষাণার্থীর মধ্যে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও ৪০০ ছেলে গার্ড অব অনারে অংশগ্রহণ করে। তারা মন্ত্রী মহোদয়ের উদ্দীপক ভাষণ শ্রবণ করেন। এ পর্যন্ত ওই ক্যাম্প থেকে ৯২৮ জনকে ইতোমধ্যেই উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। এরা নিজেরাই রেশন সংগ্রহ করে। সরকার থেকে এদের রেশন দেওয়া হয় না। এখানে বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দেয় ক্যাপ্টেন ও মেজর। অস্ত্র রয়েছে ৭০০-৮০০। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ সক্রিয়ভাবে ক্যাম্পটি পরিচালনা করেন।” তিনি ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জ।
১২. কুরমাইল ক্যাম্প। সামনে সবুজ চত্বর। শিমুল গাছে রক্ত-ফুল। বৃষ্টি ভেজা বট গাছের শিহরিত পত্রপল্লব। পুকুরে নিটোল জল। পাশে সারি সারি মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশে প্রার্থনারত বৃক্ষসারি। রাত গভীর হলে আজও মনে পড়ে ভোরের পাখিরা কী তেমনি করে ডেকে ওঠে, কম্পিত শাখায় বাতাস দোলা দেয়! সামনে শালবন। বিস্তীর্ণ শস্য খেত। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় এখানো মনে হয়, রাত জাগা গেরিলারা দলে দলে ফিরে আসছে রণক্লান্ত, অথচ বিজয়ের প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত। কখন যেন গলা ছেড়ে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠবে : জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হৃদয়-স্মৃতি। আনন্দে। বেদনায়। রক্তক্ষরণে। দীর্ঘ ৫৩ বছর আত্মজিজ্ঞাসায় পীড়ত হই এই ভেবে যে, যে দর্শন, আদর্শ ও মানব মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় হয়েছিল তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? ইতিহাসে এই সত্য যে, আমরা বিজয় অর্জন করি, কিন্তু বিজয়কে ধরে রাখতে পারি না।
লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী, লেখক ও গবেষক।