এরকম একটি দৃশ্যের স্বপ্ন দিনে রাতে কতদিন যে দেখেছি! প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্বপ্ন দেখতাম-সকালে ওঠেই যেন দেখতে পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। সব দিকই পতাকা দেখা যাচ্ছে সবুজের বুকে লাল সূর্য, মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র।
বেশ কিছুদিন ধরেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি ও ভারতের আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে দিকে দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসছে। মনে হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে নিন্ডিদ্র বর্মে। রাজাকার, আলবদর, বিহারি, পাকিস্তানের সমর্থকদের পালানোর সব পথ বন্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা মুখে বিজয়ের হাসি ও হৃদয়ে আনন্দ নিয়ে বুক চিতিয়ে দেশ মুক্ত করতে করতে আসছেন।
১৯৭১-এর ডিসেম্বর, আমি আমার সহপাঠী ও বন্ধু নরুলসহ দুজন কাউকেই কিছু না বলে বোদা থানার উত্তরের এক ক্রোশ লক্ষ্মীদারের দিকে ছুটছি। উদ্দেশ্য, বোদা থানা। তৎকালীন ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ১২ মাইল উত্তরে। ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্গত ছিল-ঠাকুরগাঁও সদর, বোদা, দেবীগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী, পঞ্চগড়, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল, হরিপুর- মোট ১০টি থানা।
যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রসফায়ার হতে পারে। অনেক সময় শত্রুসেনা পেছনে ফেরার পথে মাইন পুঁতে রাখে প্রতিপক্ষ সেনাদের বিপদগ্রস্ত করার জন্য। মাইন বিস্ফোরণে প্রতি বছর লাখ লাখ শিশু, কিশোর, যুবক, বয়স্ক মানুষ মারা যায়, বিকলাঙ্গ হয়, সে তথ্যও আমাদের জানা ছিল না।
আমার তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে। এক ভাই বোদা থানার পূর্ব-উত্তর কোণে করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডার। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এক চুড়ি-ফিতা ফেরিওয়ালা আমাদের বাড়িতে আসেন। বাবাকে নাম ধরে ডেকে খোঁজেন। আমরা প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম, রাজাকারের কোনো গুপ্তচর কি না। পরে তাকে বিশ্বাস করি। সেই ফেরিওয়ালা চুড়ির ঢাকি থেকে মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব ভাইয়ের একটা চিঠি আমার হাতে দেন। ইয়াকুব ভাইয়ের হাতের লেখা আমার খুব চেনা। মাঝে মাঝে চুড়ি ফেরিওয়ালার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন খবরাখবর আদান-প্রদান করতাম। একবার আমাদের গ্রাম থেকে ৫০ জন কিশোর ও যুবককে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। বোদা পাথরাজ নদী বাঁধের উত্তরে। বোদা বাজার বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য বাঁধ ছিল। সে বাঁধে ১১৫টি বাঙ্কার তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। ওই বাঙ্কার নির্মাণ দলে আমাকেও থাকতে হয়েছিল। পরে আমি বাঙ্কারের ম্যাপ তৈরি করে ওই চুড়ি-ফিতার ফেরিওয়ালার মাধ্যমে ইয়াকুব ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম।
শুধু আমরা দুজন ছুটছি না, হাজার হাজার মানুষ ছুটছে। বোদা লক্ষ্মীদার রাস্তা দিয়ে। লক্ষ্মীদার রাস্তা সমতল থেকে একটু উঁচুতে। সে রাস্তায় জলপাই রঙের পোশাক পরে হাজার হাজার সৈন্য। জলপাই রঙের হেলমেট মাথায়। তারা ভারতীয় অর্থাৎ মিত্রবাহিনীর সৈনিক।
সৈন্যদের হাতে, পিঠে, কাঁধে কত রকমের যে অস্ত্র, তার নাম আমাদের অজানা। সবচেয়ে বিস্ময়ের ট্যাংক, যার নাম শুনেছি। এর আগে চোখে দেখিনি। জলপাই রঙের ট্যাংকের ভিতরে শরীর, ড্রাইভারের মাথা শুধু দেখা যায়। ট্যাংকের পেছনে একজন-দুজন সৈনিক অস্ত্র হাতে থাকেন।
আমাদের জানা ছিল পাকা রাস্তা ছাড়া ট্যাংক চলতে পারে না। আমাদের সামনে যে ত্রিশ-চল্লিশটি ট্যাংক, সেগুলোর সামনে দীর্ঘ নল। সেই নল থেকে গুলি বের হয় চতুর্দিকে। এজন্য কোনো শত্রুসেনা কাছে আসতে পারে না। তখনো লক্ষ্মীদারের ধান খেতে ধান কাটা হয়নি। প্রায় সোনালি রং ধান খেতে এক হাঁটু কোথাও একটু বেশি পানি দেখা যাচ্ছে। সেই খেতের ওপর ত্রিশ-চল্লিশটা ট্যাংক লাইন ধরে নেমে গেল।
কাদা পানির ওপর সামনে চলে যাচ্ছে। তাদের টার্গেট সন্ধ্যার আগেই বোদা থানা দখল করতে হবে। সকাল থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। অনেকেই মনে করছেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাবারুদ শেষ। জনসমর্থনহীন যুদ্ধ, না পালালে জনগণই পিটিয়ে মেরে ফেলবে।
অনেকে বলছে, এটা যুদ্ধের একটা কৌশল হতে পারে। সকাল থেকে নিশ্চুপ। মুখোমুখি যুদ্ধ হবে।
বোদা বাজারে যারা পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন, যুদ্ধের আভাস পেয়ে তারা দশ-বার দিন আগেই নিরাপদে চলে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা রাস্তার ওপর গোল করে গর্ত খুঁড়েছে। মাঝখানে লম্বা নলের যন্ত্র বসিয়েছে। কেউ কেউ বলছে যদি পাকিস্তানি আর্মি বিমান আক্রমণ করে, তবে ওই লম্বা নলঅলা অস্ত্র দিয়ে শত্রু বিমান ধ্বংস করা হবে। ওমরখানা থেকে কয়েক দিন ধরেই মুক্তিবাহিনী পাকা রাস্তা দিয়ে সামনে এগোচ্ছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী রাস্তার দুই পাশ থেকে তাদের সাপোর্ট দিচ্ছে।
পাথরাজ নদীর ওপরে ব্রিজের পশ্চিম ও দক্ষিণ কোণে পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্প। মুক্তিকামী ছাত্র, যুবক, বয়স্ক ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে এসে রাজাকাররা আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। মুক্তিকামী-মানুষের টর্চার সেল। কখনো কখনো পা উপরে মাথা নিচে, আবার হাত উপরে পা নিচে ঝুলিয়ে নির্মম নির্যাতন চলত। নির্যাতন করতে করতে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত অত্যাচার। যখন যেমন খুশি, তেমন অত্যাচার চালানো হয়। শনিবার-বুধবার বোদা হাট। বিকাল হতে না হতে হাট ভেঙে দেওয়া হয়। ব্রিজের দুই পাশে রাজাকার থাকে রাইফেল কাঁধে। যুবক দেখলেই ব্রিজের নিচে নিয়ে যায়। প্রথমে পরীক্ষা করে কাপড় খুলে, হিন্দু না মুসলমান। মুসলমান হলে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়। হিন্দু হলে পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। সেখানে তার ভবিষ্যৎ নেহাতই অনিশ্চিত। এমন অনেককেই আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব দিন গেছে গত নয় মাস। তারপর বিজয়ের ডিসেম্বর।
সেদিন সন্ধ্যা হতে না হতেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে চলে আসে বোদার নিয়ন্ত্রণ। চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জয় বাংলা! জয় বাংলা! ধ্বনি দিতে দিতে বোদা বাজারে প্রবেশ করছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড়-চোপড়ের শ্রী-ছাদ নেই। দীর্ঘ চুল দাঁড়ি। কারও হাতে রাইফেল, কারও স্টেনগান-গ্রেনেড। শরীরে ক্লান্তি কিন্তু দুচোখে বিশ্বজয়ের দ্যুতি। স্বপ্নের, সংগ্রামের, সম্ভ্রমের, রক্তের দামে কেনা বিজয় দেখল স্বাধীন বাংলাদেশ।
লেখক : গল্পকার, প্রাবন্ধিক